× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জাতীয়তাবাদ থেকে বহুত্ববাদ

উত্তরণের পথে এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত

কাজী লতিফুর রেজা

প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৯ পিএম

কাজী লতিফুর রেজা

কাজী লতিফুর রেজা

যেকোনো সংকট ও সংঘাতের মাধ্যমে জন্ম নেয় নতুন সম্ভাবনা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দীর্ঘ গণতন্ত্রহীনতার ফসল। আর এ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবসান ঘটে বিগত সরকারের। আমরা দেখতে থাকি নতুন স্বপ্ন। কুয়াশায় ঢাকা আকাশে খেলা করছে নতুন আলো। দলিত ঘাসের মাঠে হচ্ছে আমাদের আকাঙ্ক্ষার নবনির্মাণ, বিনির্মাণ বা সংস্কার। সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে কমিশনের সুপারিশ যেমন দেখছি, তেমন সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা শুনছি তরুণদের মুখে।

আমরা জানি, সংবিধান কোনো স্থবির বিষয় নয়। সময়ের প্রয়োজনে কখনও কখনও সংস্কারের আবশ্যক হয়। জুলাই আন্দোলন সংবিধানের মূলনীতি পর্যালোচনা আবশ্যক করে তুলেছে।

আমি আজ আলোচনা করব বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বতন্ত্রভাবে বহাল থাকবে, না বহুত্ববাদের মহাসমুদ্রে বিলীন হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের যে চেতনার জন্ম তা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের পরিক্রমায় পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। জাতীয়তাবাদ যেমন একদিকে একটি জাতির আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার, অন্যদিকে বহুত্ববাদী সমাজে সমন্বয়ের জন্য চ্যালেঞ্জও বটে। সেই আঁচ পাওয়া যায় গণপরিষদের অধিবেশনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বক্তৃতায়।

কেমন করে এ জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম- বাঙালির ইতিহাস, এ জনজাতির ইতিহাস খুঁড়ে দেখে নেওয়া যাক। বাংলার ইতিহাসে শুধু দেখা যাবে পাল-সেনদের ইতিহাস, পাঠান-মুঘলের ইতিহাস, ইংরেজ রাজত্বের ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় বাঙালি শাসন বা জাতীয়তাবাদের ইতিহাস প্রায় বিরল। বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের হলেও, মোটা দাগে বাঙালি জাতিসত্তার জাতীয়তাবাদের ইতিহাস দেড়শ বছরের বেশি নয়।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমার্থক হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম ব্রিটিশশাসিত ভারতের বাংলায় ১৮৬০ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে। ইংরেজ রাজত্বে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালির যে জাগরণ দেখা যায়, ইতিহাসের ঘটনাক্রমে তারা প্রায় সবাই ‘হিন্দু’ ছিল। ইতিহাস বলছে, এ সময় বাঙালি ও হিন্দু শব্দদ্বয়ের অর্থ একাকার হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অনেকটা হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমার্থক হয়ে ওঠে। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।’ এ কথা থেকে বিষয়টি আরও গভীরভাবে স্পষ্ট হয়। এ হিন্দুঘেঁষা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে ১৯০৩-১১ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঘেঁষা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি মুসলিম সমাজকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাঙালি ও হিন্দু শব্দদ্বয়ের তৎকালীন অভিব্যক্তি আদতে এ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সংকট আরও প্রকট করে তুলেছিল।

যদিও ১৯২০-এর দশকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরও জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস নেন। দেশবন্ধু বলছেন, ‘বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা, ধর্মীয় পরিচয় থেকে শক্তিশালী।’ কিন্তু দেশবন্ধুর আন্দোলন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন সফল হয়নি। ঘোচেনি দোদুল্যমান হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের রঙ, বাঙালি আত্মপরিচয়সংকট। হিন্দুরা যেমন মুসলমানদের বাঙালি বলতে নারাজ, তেমন অদ্ভুতভাবে মুসলমানরা আরবে নাড়ি পোঁতা বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে থাকে।

বাঙালির অদ্ভুতুড়ে অবস্থা ব্যাখ্যা করেন আহমদ শরীফ ‘বাঙালির ইতিহাস সন্ধানে’ প্রবন্ধের পঞ্চম অনুচ্ছেদে। তিনি বলছেন ‘...বহুকাল এ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ অভিন্ন জাতিসত্তায় সংহত হতে পারেনি। বরং বিভিন্ন বিদেশি আঞ্চলিক শাসনে ক্লিষ্ট, আত্মপ্রত্যয়হীন মানুষ আত্মমর্যাদা লাভের বিকৃত বাসনায় মিথ্যা পরিচয়ে আত্মতুষ্টির যে পথ অবলম্বন করেছিল তা পরিণামে আত্মহননের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেননা, এতে জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রায় চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। ওই বৈনাশিক সংস্কারের প্রভাব আজও অম্লান। বাঙালিমাত্রেই তাই সত্য পরিচয় স্বেচ্ছায় পরিহার করে আঙ্গীকৃত সরকার ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিকে স্বদেশ এবং শাস্ত্রকার ও শাসকের স্বজাতি বলে জেনে আত্মপ্রবোধ পেতে থাকে। তাই এ দেশে বৌদ্ধমাত্রেই ছিল মগধী, ব্রাহ্মণ্যবাদীমাত্রেই আর্যাবর্ত ব্রহ্মবর্তের আর্য। মুসলিম মাত্রেই আরব-ইরানি কিংবা মধ্য-এশীয়। ফলে আজও শিক্ষিত অভিজাত বাঙালিমাত্রেই চেতনায় প্রবাসী ও বিদেশি জ্ঞাতিত্বগর্বী, তাই ভিন্নমতের প্রতিবেশীমাত্রেই পর।’ ড. আহমদ শরীফের এ বক্তব্য থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে কেন বাঙালি কোনোকালেই ‘অভিন্ন জাতিসত্তা’য় সংহত হতে পারেনি।

হিন্দুত্বে রঙিন বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে ১৯২১ সালের বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ আন্দোলন ১৯৪৭-এ এসে ফিকে হয়ে যায়। বিভক্ত বাংলার পশ্চিম অংশ ভারতীয় জাতীয়তায় বিলীন হয়। তবে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ‘অভিন্ন জাতিসত্তা’র অনুভূতি নবকলেবরে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্ফুরণ ঘটে। বাঙালি হিসেবে আত্মোপলব্ধি ও অহংকারের যে চেতনার জন্ম, তা হলো সত্যিকারের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। যেখানে ধুয়ে মুছে গেছে আগের ধর্মঘেঁষা মনোভাব, আত্মপরিচয়ের দোদুল্যমানতা। এ চেতনা পূর্ণতা লাভ করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ আমাদের বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এমন অভূতপূর্ব ঘটনা কোনোকালেই ছিল না। এমন ঘটনা বাঙালির ইতিহাসে নেই বললেই চলে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালির সত্যিকারের নিজেদের রাষ্ট্র। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের বাঙালির জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের।

বাংলাদেশ পার করেছে স্বাধীনতার ৫০ অধিককাল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার আন্দোলনে যুক্ত ছিল বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিসর ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। যদিও আন্দোলনে অনুসর্গ শুধু জাতীয়তাবাদ নয়।

পরবর্তীসময়ে সংবিধান প্রণয়নের সময়কার বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বাংলাদেশের ঐক্য। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেন। সেদিন বাংলাদেশের নাগরিককে বাঙালি বলে আখ্যায়িত হওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বহুত্ববাদের প্রয়োজনীয়তা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বহুত্ববাদকে বোঝাপড়ার ব‍্যর্থতা, ভ্রমাত্মক ও অদূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই বাঙালি ও পাহাড়ির মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। এটি ছিল ঐতিহাসিক বড় ভুল। বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ও তরুণদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, ইতিহাসের ক্রমধারা বাঙালি জাতীয়তাবাদীকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করতে গিয়ে নতুন আত্মঘাতী ও আত্মপ্রবঞ্চনার জন্ম না দিয়ে বসে। বহুত্ববাদ হলো বিভিন্ন ফুলের রঙিন বাগান। ঠাঁই হয় সব ভিন্নতার। 

সংবিধান সংস্কারের ধারাবাহিকতায় সংবিধানে বহুত্ববাদ মূলনীতি হিসেবে আসতে পারে তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অস্বীকার করে নয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সড়ক ধরে বহুত্ববাদের মহাসড়কে উত্তরণ ঘটতে পারে।

আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে আত্মপ্রবঞ্চক দ্বৈরথ মনের বর্ণনা করেছেন। তার দেখা আবার পেলাম সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বাদ দিয়ে, এ জনজাতির মনের গভীরের দ্যোতনা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ করেছে। ইতিহাসের নিরিখে বাঙালি হিসেবে নিজের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এবং জাতীয়তাবাদ সাংবিধানিক নীতির প্রথম ধাপ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রেখেই সামনে অগ্রসর হওয়া উচিত। বহুত্ববাদ সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে সেটি কোনোভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিযুক্ত করে নয়।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র বয়ানে, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার কোনো জো-টি নেই।’

জাতীয়তাবাদ বিযুক্ত হলে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য আঞ্চলিক, ধর্মীয় বা সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজনের শিকার হতে পারে। জাতীয়তাবাদ জনগণকে একত্র করে একটি অভিন্ন পরিচয় দেয়। এটি বাদ গেলে জাতীয় ঐক্যের অভাব সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, জাতীয়তাবাদ কেবল একটি আদর্শ নয়; এটি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদকে বাদ দেওয়া মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐক্যে ফাটল ধরাবে।

তবে স্বাধীনতার এ মহান সংগ্রামে বাঙালি ছাড়া আরও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করে। নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ সব জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বহুত্ববাদী পরিচয় গড়ে তোলা যেতেই পারে এবং তেমনটাই বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অভীষ্ট লক্ষ্য।

জুলাই আন্দোলনের চেতনায় সব বৈষম্য নিরসন করে বহুত্ববাদ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। জাতীয়তাবাদ অপরিবর্তনীয় একটি মূলনীতি হিসেবে রাখা উচিত হবে চেতনার প্রথম পর্যায় হিসেবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বহুত্ববাদ উত্তরণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত যেতে পারে।

  • সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, আর পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা