সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪৬ পিএম
আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৪ পিএম
বিভিন্ন প্রকল্পে কাজে ধীরগতির খবর নতুন। প্রকল্পের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ে, তার পরও প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না, এমন নজির আমাদের সামনে অনেক। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ দ্বিগুণ বা তারও বেশি সময় লেগে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। এর ফলে শুধু যে জনভোগান্তিই বাড়ে তা নয়, একই সঙ্গে বাড়ে প্রকল্প ব্যয় এবং অর্থের অপচয়ও। ৭ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘সময় ও ব্যয় বাড়িয়েও অর্ধেক কাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মহেশখালীতে নতুন জেটি নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকেই নানা অনিয়ম, ৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় ধাপে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি এবং দীর্ঘ সময়ে প্রকল্পের কাজ ৫৫ শতাংশ শেষ হওয়া- এ-সংক্রান্ত যে চিত্র উঠে এসেছে তা এর বাইরে নয়। প্রতিবেদনে জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগের প্রধান মাধ্যম কক্সবাজার-মহেশখালী নৌপথ। এই নৌপথে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে বিলম্ব এবং পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে আছে। স্থানীয়রা এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সময়সীমা একাধিকবার বাড়ানো হলেও প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ২৭ জুন শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু কচ্ছপ গতিতে চলায় এখন পর্যন্ত ৫৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বরং প্রকল্পের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। জেটি নির্মাণে বিলম্বের কারণে মহেশখালী-কক্সবাজার নৌপথে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার যাত্রীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জরাজীর্ণ কাঠের জেটি দিয়ে নামতে গিয়ে অনেকেই পা ফসকে পানিতে পড়ে যায়। বিশেষ করে প্রবল জোয়ারভাটার সময় এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এ ছাড়া যাত্রীহয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, স্পিডবোট চালকদের নৈরাজ্য এবং দুর্ঘটনার খবর তো নিত্যদিনের। ফলে যাতায়াতে বিড়ম্বনার শিকার হন অসহায় যাত্রীরা।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ২০২৩ সালে পুরোনো জেটির পাশে ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে হাজারো বাইন গাছ কেটে নতুন জেটি বানানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। পরে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আপত্তি জানায় বন বিভাগ। এ নিয়ে প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় বন বিভাগ ও এলজিইডির মধ্যে আলোচনার কথা থাকলেও ফলপ্রসূ কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু প্যারাবনের হাজারো বাইন গাছ কেটে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে এলজিইডি। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হাজারো গাছ কাটা উপকূলীয় বাসিন্দাদের জন্য একটি অশনিসংকেত। উল্লেখ্য, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে বন বিভাগ যে বাইনবাগান গড়ে তুলেছিল, তা এখন বিলুপ্তির পথে। পরিবেশবিদদের মতে এ গাছগুলো উপকূলীয় এলাকার সুরক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু নতুন জেটি নির্মাণের নামে এ গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এটা পরিবেশগতভাবেও মারাত্মক ক্ষতিকর কারণ।
এ কথা সত্য, উন্নয়নের নামে প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কথা অতীতের সরকারগুলোর সময় অহরহ শোনা যেত। তখনও গণমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসত কাজের ধীরগতি, উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, সঠিক সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে না পারা, নানা কারণে সরকারি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি। এ বৃদ্ধির কারণে সরকারি তহবিলের কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। আমরা মনে করি, কোনো নির্মাণ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় হবে বা ওই স্থাপনার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ব্যয় কমাতে প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ হবে না। বরং দুর্নীতি-অনিয়ম উন্নয়নের সব বরাদ্দ গ্রাস করে ফেলতে পারে। ফলে শত চেষ্টা থাকলেও প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা হবে সুদূরপরাহত।
আসলে দুর্নীতি চলতে থাকলে উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এজন্য সামষ্টিক উন্নতির স্বার্থে আমাদের দুর্নীতি-অনিয়ম থেকে দূরে থাকা উচিত। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের গুরুত্ব সীমাহীন। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার দুর্নীতিমুক্ত থাকা উচিত। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। যেকোনো প্রকল্প বরাদ্দের আগে বাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা এবং সক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে আইনের সংস্কারও করা দরকার। যেকোনো মূল্যে দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, বর্তমান প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ করা হবে এবং নতুন কোনো প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় যাতে না হয়, তা-ও নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মনে রাখতে হবে, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি সহায়তা নিতে গেলে সমীক্ষা লাগে, শর্ত পূরণ করতে হয়। সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছেও ইতিবাচক বার্তা যায় না। আমরা মনে করি, নিবিড় সমীক্ষাপূর্বক কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে রাষ্ট্রীয় অর্থ গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা কমবে। এখন নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের সময়। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও ব্যয়বৃদ্ধির অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাটাও জরুরি।