মো. অহিদুর রহমান
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ২০:০০ পিএম
মো. অহিদুর রহমান
দেশের পানিসম্পদ দিনদিন শেষ হয়ে আসছে। আমরা যদি পানি সমস্যার সমাধান না করি, আমাদের গ্রহটি অন্য গ্রহের মতোই হয়ে যাবে। পাহাড় থেকে হাওর, সমতল থেকে সমুদ্র উপকূল, রাজশাহী থেকে ঢাকা সর্বত্রই পানির জন্য হাহাকার। দেশের নদ-নদী, হাওর, বিল, খাল, পুকুর, ডোবা, খাড়িসহ সব জলাভূমি আজ শূন্য থাকে বছরের আট মাস। কৃষক পাচ্ছে না সেচের জন্য ভূ-উপরিভাগের পানি, ভূগর্ভের অদৃশ্য পানিসম্পদ ধীরে ধীরে নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। নেত্রকোণার সীমান্ত অঞ্চলের আদিবাসীসহ সব পেশাবৈচিত্র্যের মানুষ আজ যেমন ভয়াবহ পানি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তেমন রাজশাহীর বরেন্দ্র ও উপকূলের মানুষ সুপেয় এক কলসি পানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। সীমান্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বিশেষ করে আদিবাসীরা নিরাপদ পানীয় জলের জন্য, পাহাড়ের ছড়া থেকে বিন্দু বিন্দু ফোঁটা পানির জন্য দিনরাত অপেক্ষা করে এক কলসি পানি সংগ্রহ করেন। রাজশাহীতে পানির জন্য কৃষকের আত্মহত্যা, উপকূলে এক কলসি পানির জন্য নারী-পুরুষ-কিশোরীর প্রাণান্ত যুদ্ধ, নেত্রকোণার সীমান্তের গ্রামে আদিবাসী নারীদের পাহাড়ের ছড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় এক কলসি পানির জন্য।
উল্লেখ্য, পানি ও স্যানিটেশন সংকট মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রতি বছরই বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়ে থাকে। ২০২৫ সালের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘হিমবাহ সংরক্ষণ’, যা জীবন ও পানিচক্র টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে হিমবাহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে। হিমবাহ, পাহাড়ের পানিস্তর এবং তুষার গলনের ফলে প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ পানীয়, কৃষি এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য পানি পায়। হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ত্বরান্বিত করা এবং সংকুচিত হিমবাহ ও জলপ্রবাহের অনিশ্চয়তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয় কৌশল বাস্তবায়নে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। মানুষের সৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ফলে কার্বনের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে দিনদিন। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, গলে যাচ্ছে বরফ। মানুষের ভোগবিলাসের কারণে এ সুন্দর পৃথিবী ডুবে যেতে পারে না।
জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ প্রথম পালিত হয় বিশ্ব পানি দিবস। জাতিসংঘ-ঘোষিত প্রতিটি দিবসের মতোই পানি দিবসে প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য থাকে। ১৯৯৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল পানিসম্পদ সুরক্ষা সবার দায়িত্ব, ১৯৯৫ সালে নারী ও পানি, ১৯৯৬ সালে তৃষ্ণার্ত নগরীর জন্য পানি, ১৯৯৭ সালে বৈশ্বিক পানি কি যথেষ্ট, ১৯৯৮ সালে ভূগর্ভস্থ পানি অদৃশ্য সম্পদ, ১৯৯৯ সালে সকলেই ভাটিতে, ২০০০ সালে একুশ শতকের জন্য পানি, ২০০১ সালে স্বাস্থ্যের জন্য পানি, ২০০২ সালে উন্নয়নের জন্য পানি, ২০০৩ সালে ভবিষ্যতের পানি, ২০০৪ সালে পানি ও দুর্যোগ, ২০০৫ সালে জীবনের জন্য পানি, ২০০৬ সালে পানি ও সংস্কৃতি, ২০০৭ সালে পানিহীনতা, ২০০৮ সালে পয়োনিষ্কাশন, ২০০৯ সালে অভিন্ন জল ও জলের ভাগ, ২০১০ সালে পানির গুণগত মান, ২০১১ সালে নগরের জন্য পানি, ২০১২ সালে পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ২০১৪ সালে পানি ও শক্তি, ২০১৫ সালে পানি ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন, ২০১৬ সালে ভালো পানি ভালো কাজ, ২০১৭ সালে কেন বর্জ্যপানি?, ২০১৮ সালে পানির জন্য প্রকৃতি, ২০১৯ সালে কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সবার জন্যই পানি; ২০২০ সালে পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন, ২০২১ সালে ভ্যালুয়িং ওয়াটার (মূল্যবান পানি), ২০২২ সালে ভূগর্ভস্থ পানি : অদৃশ্য পানি, দৃশ্যমান প্রভাব; ২০২৩ সালে পানি ও পয়োনিষ্কাশন সমস্যা দ্রুত সমাধান করি এবং ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য হলো পানি শান্তির জন্য।
নদী, হাওর, খাল, বিল, পুকুর, ছড়া, ঝরনা, ঝিরি, হ্রদ, দিঘি, ডোবা, নালা, ভাড়ানি, বাঁওড়, খাড়ি, লেকসহ কত জলাধার বাংলাদেশে! পানি নিয়ে দেশে আছে একটি নীতিমালা ও একটি আইন। ‘জাতীয় পানিনীতি, ১৯৯৯’ এবং ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩’। পানি আইনে হয়েছে, পানিসম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে বিধান প্রণয়ন সমীচীন বলে আইনটি করা হয়েছে। পানীয় জল আজ বহুজাতিক কোম্পানির বোতলে বন্দি। নামে বেনামে কত ব্যবসা ও কত লাভলোভের জায়গা তৈরি হয়েছে এ পানি নিয়ে। ভূগর্ভের পানি টেনে তোলা হচ্ছে। আমাদের পাতাল পানিশূন্য হয়ে পড়েছে।
দেশজুড়েই প্রাণ ও প্রকৃতিতে সংকট চলছে। দরকার সামষ্টিক তৎপরতা। জলের জন্য আসমুদ্রহিমাচল জাগরণ। চারধারের প্রকৃতির প্রতি নতজানু হলেই আমরা টের পাব পাতাল কি পাহাড়ে পানির অবিরাম গুঞ্জরণ। শুধু মানুষ নয়, আমাদের চারধারের দেখা-অদেখা শত কোটি প্রাণের পানিময় আহাজারিকে কলিজায় ধারণ করেই বিকশিত হোক আমাদের জলদুনিয়া। বছরের আট মাসই পানির জন্য সীমান্তের নারীরা বন, পাহাড়ের ছড়ার কাছে অপেক্ষা করেন। নেত্রকোণার কলমাকান্দা অঞ্চলের সীমান্তের নারীরা প্রতিদিন এক কলসি পানির জন্য পাহাড়ের গর্ত, নালা, ছড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। এ সমস্যা দীর্ঘ ২০-৩০ বছর ধরে চলে আসছে বলে জানান এলাকার ভুক্তভোগীরা। কলমাকান্দা ঘুরে দেখা যায়, নারী, শিশু, প্রবীণ নারীরা দূরের পাহাড়ি টিলা হয়ে নেমে আসা নালা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন নিরাপত্তাহীনতার ভেতর দিয়ে। নেত্রকোণার সমতলের নদী, হাওর, বিল, খাল, পুকুরসহ সব জলাধার আজ শুকিয়ে পানির জন্য এক ধরনের হাহাকার তৈরি হয়েছে।
বিশ্বে পানির উৎস প্রতিদিনই কমছে। পানিসংকটের মুখে পড়ছে মানবজাতি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা (নাসা) বলছে, পৃথিবীর ভূগর্ভে পানির যত মজুদ আছে তার এক-তৃতীয়াংশই মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ স্তরগুলোর অবস্থান ভারত ও চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সীমানার মধ্যে। নাসা ১৩টি পানির স্তরকে আখ্যায়িত করেছে চরম সংকটাপন্ন হিসেবে; যেগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। এ স্তরগুলো ব্যবহার উপযোগী করা অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়ে স্তরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পানির স্তর নেমে যাওয়ার বিপদ থেকে নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশও মুক্ত নয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে।
হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত ছোটবড় শত শত নদীর আশীর্বাদে গড়ে ওঠা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ ছিল মিঠাপানির আধার। এখানকার ভূগর্ভেও যত সহজে আদর্শ পানির দেখা মিলত, তা প্রায় নজিরবিহীন। কিন্তু নির্বিচার দূষণ, দখল, ভরাটের কারণে ইতোমধ্যে নদী, নালা, খাল, বিলের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কৃষি সেচ ও নাগরিক ব্যবহারের জন্য মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলন ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও সৃষ্টি করেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। আমরা জানি, দেশের অধিকাংশ শহরই কোনো না কোনো নদীর তীরে অবস্থিত। সবকটিতে যদি নদীর পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে সারা দেশেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমে আসবে। সে ক্ষেত্রে অভিন্ন নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহের বিকল্প নেই। আমরা চাই উদ্যোগ ও উদ্যম। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষের জন্যও এটা সত্য। সব পক্ষ আন্তরিক হলে পানিসংকট নিরসন কঠিন হবে না। ধান চাষে ভূগর্ভের পানি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়িঘরের গভীর নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। পুকুর-জলাশয়েও পানি থাকছে না। সুপেয় পানি কিনে খেতে হচ্ছে।