× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সংগ্রামটা কঠিন, দীর্ঘ এবং কষ্টদায়ক

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৫৫ পিএম

সংগ্রামটা কঠিন, দীর্ঘ এবং কষ্টদায়ক

ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স এবং অর্থনীতি আমার লেখার বিষয় হলেও কিছু সমসাময়িক বিষয় নিয়ে একেবারে যে লেখি না তেমন নয়। কিন্তু এ রকম একটি বিষয় নিয়ে কখনও লিখতে হবে, তা একেবারেই ভাবনার মধ্যে ছিল না। সম্প্রতি এ বিষয়গুলো অনেকেই জানতে চান। আবার অনেকের জানার সুযোগও সেভাবে হয় না। এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে লেখা। বিগত দুই বছরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কানাডা এসে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে অ্যাসাইলাম প্রার্থনা করে বসে আছেন। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে, গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক বেশি বাংলাদেশি এখানে এসে অ্যাসাইলাম চেয়ে বসেছেন। বিষয়টি মোটেই তা নয়। আমি যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির কথা বলছি, তাদের সবাই এসেছেন ৫ আগস্টের ঘটনার আগে। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর এ সংখ্যা অনেক বাড়তে পারত, কিন্তু তা হয়নি। কারণ তার আগেই ভ্রান্ত অভিবাসন নীতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় কানাডা সরকার এভাবে আসার পথ কঠোর করেছে। ফলে অনেকে চেষ্টা করেও আসতে পারেননি। যাদের আগে থেকে কানাডার ভিসা নেওয়া ছিল, তাদের মতো কয়েকজন আসতে পেরেছেন এবং এদের সংখ্যা হাতেগোনা।

অ্যাসাইলাম পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ, তাই অনেকেরই নানান কারণে কানাডার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কানাডায় এসে অ্যাসাইলাম প্রার্থনা করে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক গ্রুপ আছেন যারা খুবই সাধারণ মানের এবং তাদের সংখ্যাই বেশি। অন্য একটি গ্রুপ আছেন যারা বেশ অবস্থাসম্পন্ন এবং অভিজাত পরিবারের সদস্য। এ গ্রুপের সংখ্যা অবশ্য খুব বেশি নয়। এ ছাড়া আরও ভিন্ন দুই ধরনের বাংলাদেশি এভাবে কানাডায় এসেছেন। তাদের মধ্যে এক গ্রুপ আছেন যারা পরিবারের সব সদস্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আরেক গ্রুপ পরিবারের সবাইকে দেশে রেখে নিজে একা এসেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, শেষোক্ত গ্রুপের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ এবং তাদের কষ্ট ও অনিশ্চয়তার বেদনা বর্ণনাতীত।

অ্যাসাইলাম প্রার্থীদের ধারণা বা তাদের বোঝানো হয়েছে যে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে দেড় থেকে আড়াই বছর লেগে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কানাডায় এমনিতেই সরকারি অফিসের কাজ ধীরগতিতে চলে। তাছাড়া অ্যাসাইলাম বা ইমিগ্রেশনসংক্রান্ত কাজে অনেক বেশি সময় লাগে। সব যদি ঠিকঠাক থাকে, অর্থাৎ প্রথম শুনানিতেই যাদের অ্যাসাইলাম অনুমোদন হয়, তাদেরও কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যায়। কারণ তিনটি ধাপে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে অ্যাসাইলাম আবেদন গৃহীত হতে হবে এবং তখন নিজ দেশের পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিতে হবে। এর সঙ্গে কানাডার বাইরে যাওয়ার পথটা আপাতত বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় ধাপে এ আবেদনের ওপর শুনানি হবে, যা সাধারণত আবেদন গৃহীত হওয়ার দেড় থেকে দুই বছর পর হয়ে থাকে। এ সময়ে অ্যাসাইলাম প্রার্থীর স্ট্যাটাস হয় আবেদনকারী বা ক্লেইমন্যান্টা। যাদের কপাল ভালো, তাদের অ্যাসাইলাম প্রথম শুনানিতেই অনুমোদন হয়। তখন তারা পার্মান্যান্ট রেসিডেন্ট বা পিআরের জন্য আবেদেন করতে পারেন। সে আবেদন গৃহীত হওয়ার পর এক থেকে দেড় বছর লাগতে পারে পিআর পাওয়ার জন্য। এ সময় সে আবেদনকারীর স্ট্যাটাস হবে সুরক্ষিত ব্যক্তি (প্রটেকটেড পারসন)। যাদের আবেদন প্রথম শুনানিতে অনুমোদন হয় না, তাদের আরও বেশি সময় লেগে যায়। আর যাদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়, তাদের কী হবে, তা বলা কঠিন।

এ দীর্ঘ সময়ের কারণেই এখন অনেকেই ভাবছেন অ্যাসাইলাম আবেদন বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় কানাডার বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ আছে কি না। এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া বেশ কঠিন। কেননা কাগজে কলমে কানাডার বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবে সে সুযোগ কতটা গ্রহণ করা সম্ভব, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। আবার এ সুযোগ যে সবাই ঢালাওভাবে পাবেন তেমন নয়। অ্যাসাইলাম প্রার্থীদের মধ্যে যারা প্রটেকটেড পারসন হিসেবে চিহ্নিত হবেন, অর্থাৎ যাদের অ্যাসাইলাম অনুমোদন হবে, কেবল তারাই এ সুযোগ নিতে পারবেন। যাদের আবেদন শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছে, অর্থাৎ স্ট্যাটাস হচ্ছে আবেদনকারী বা ক্লেইমন্যান্ট, তাদের এ সুযোগ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেননা এ-সংক্রান্ত কানাডার ইমিগ্রেশন বিধিতে শুধু প্রটেকটেড পারসনের কথাই বলা আছে।

যাদের এ সুযোগ আছে তাদের জন্য প্রাথমিক কাজ হচ্ছে একটি ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা, যাকে মূলত রিফিউজি ট্রাভেল ডকুমেন্ট বলা হয়। এ সুযোগ অবশ্য ব্যক্তি উদ্যোগে অ্যাসাইলাম প্রার্থী এবং সরকারি উদ্যোগে অ্যাসাইলাম প্রার্থী, উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যক্তি উদ্যোগে অ্যাসাইলাম প্রার্থী হচ্ছেন তারাই, যারা বৈধ ভিসা নিয়ে কানাডা এসে অ্যাসাইলাম লাভের জন্য আবেদন করে অ্যাসাইলাম পেয়েছেন। পক্ষান্তরে কানাডা সরকার চাইলে কোনো দেশের নাগরিককে বিশেষ কারণে সরাসরি অ্যাসাইলাম দিয়ে এখানে নিয়ে আসতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল ইউক্রেনের নাগরিকদের বেলায়। এ ক্ষেত্রে যাকে অ্যাসাইলাম প্রদান করা হয়, তিনি কানাডা প্রবেশের প্রথম দিন থেকেই পিআর হয়ে যান, যে সুযোগ ব্যক্তি উদ্যোগে অ্যাসাইলাম প্রার্থীরা পান না। পিআর হলেও তারা যেহেতু কানাডার নাগরিক তখনও হননি, তাই তাদের কানাডার বাইরে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়।

এ ট্রাভেল ডকুমেন্ট মূলত পাসপোর্টের মতোই কানাডার সরকার প্রদত্ত একটি ট্রাভেল আইডি, যা পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রদান করা হয়। পাসপোর্টের মতোই এ ডকুমেন্ট কাজ করে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাসপোর্টের মতোই গ্রহণ করে থাকে। কানাডার পাসপোর্ট অফিসে আবেদন করে এ ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে হয়। আবেদনের সঙ্গে ইমিগ্রেশন ও রিফিউজি বোর্ড থেকে আবেদনকারীর স্ট্যাটাস অর্থাৎ প্রটেকটেড ব্যক্তি বা পিআর উল্লেখ করে যে চিঠি ইস্যু করা হয়, তার কপি প্রদান করতে হবে। ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাসপোর্টের মতো হলেও পাসপোর্টের সঙ্গে এর বিস্তর পার্থক্য আছে। পাসপোর্টহোল্ডারকে অন্যান্য দেশ কানাডার নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করবে, কিন্তু ট্রাভেল ডকুমেন্ট বহনকারীকে কানাডার রিফিউজি হিসেবে আশ্রিত ব্যক্তি বিবেচনা করে। দ্বিতীয়ত. কানাডার পাসপোর্ট নিয়ে অনেক দেশে ভিসাবিহীন প্রবেশাধিকার আছে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অনেক দেশ, সিংগাপুর, জাপান, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ। পক্ষান্তরে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে এ ভিসাফ্রি ভ্রমণের সুযোগ থাকে না। সেসব দেশে ভ্রমণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা নিতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে কোনো দেশের ভিসার জন্য আবেদন করলে সে দেশ কানাডার ভিসানীতি প্রয়োগ না করে আবেদনকারী যে দেশের নাগরিক সে দেশের জন্য প্রযোজ্য ভিসানীতি প্রয়োগ করবে।

কোনো বাংলাদেশি যদি ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদন করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা অফিসার সে আবেদন কানাডীয় নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না দেখে বাংলাদেশের নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবেন এবং সে অনুযায়ী ভিসা দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এ ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে আবেদনকারী একটি দেশের অ্যাসাইলাম প্রার্থী। এ রকম একজন ব্যক্তিকে সে দেশে প্রবেশ করতে দেবে কি না, তা তাদের একান্ত নিজস্ব বিষয় হলেও এতটুকু অন্তত আন্দাজ করা যায় যে সবচেয়ে কঠোর ভিসানীতিই এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। ফলে অধিকাংশ অ্যাসাইলাম প্রার্থীর ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ভিসা না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ কারণেই অ্যাসাইলাম প্রার্থী হয়ে কানাডার বাইরে যাওয়া আপাতদৃষ্টে সহজ মনে হলেও বাস্তবে সহজ নয়। ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা সহজ হলেও ভিসা সংগ্রহ করার কাজটি মোটেও সহজ না।

আরেকটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে যারাই অ্যাসাইলাম নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের সুস্পষ্টভাবে যে তিনটি শর্ত মেনে চলতে হবে তা হচ্ছে ১. কোনো অবস্থায়ই নিজ দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ভ্রমণ করা যাবে না, অন্তত কানাডার পাসপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত। ২. নিজ দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশ ভ্রমণ করা যাবে না। অনেকের একাধিক বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকতে পারে এবং এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ৩. নতুন পাসপোর্টের জন্য নিজ দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশে আবেদন করা যাবে না। এর যেকোনো একটি পদক্ষেপ নিলেই অ্যাসাইলাম প্রার্থীর আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।

মোট কথা সংগ্রামটা বেশ কঠিন, দীর্ঘ এবং কষ্টদায়ক। সহজ এবং শর্টকাট কোনো পথ এখানে নেই। যারা ইতোমধ্যে এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, তাদের সঠিকভাবে না বুঝে এ সংগ্রামের মাঝখানে শর্টকাট কিছু করতে গিয়ে বড় ধরনের সমস্যা তৈরির কোনো অর্থ হয় না। যেহেতু সংগ্রামে অবতীর্ণ এবং ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পাড়িও দেওয়া হয়ে গেছে, তাই এর শেষ নিষ্পত্তি পর্যন্ত লেগে থাকতে এবং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। এর বাইরে আপাতত কোনো বিকল্প কিছু করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। যেসব ল’ ইয়ার বা পেশাজীবী এ বিষয়গুলো দেখছেন তাদের উচিত এ গ্রাহকদের (অ্যাসাইলাম প্রার্থী) জটিল বিষয়টি বেশ ভালো করে এবং যথেষ্ট খোলামেলাভাবে ব্যাখ্যা করা, যাতে তারা অধৈর্য বা বিচলিত না হন।

  • সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা