সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৪৬ পিএম
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৪৯ পিএম
ঈদযাত্রায় সড়কে প্রাণহানি যেন নিয়তি। এবার ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে চার দিনে দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৫ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার চুনতি জাঙ্গালিয়ায় পর পর তিন দিনে ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। জানা যায়, এই মহাসড়কে শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে।এগুলো এক একটি যেন মৃত্যুকূপ। দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, দুই পাশে ঘন বনাঞ্চল, লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানি, অপ্রশস্ত সড়ক, ঢালু সড়ক ও দূরপাল্লার গাড়িচালকদের অভিজ্ঞতার অভাব- এই ছয়টি কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে।স্থানীয়দের কাছে এটি দুর্ঘটনার হটস্পট হিসেবে পরিচিত।উল্লিখিত কারণ ও চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান করা না গেলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।পুলিশ ও যোগাযোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ অবৈধ যানবাহন এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। আমাদের দেশে ঈদের আগে সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিয়তি। প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে যে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় তা থেকে এবারও রক্ষা মেলেনি। এর আগে ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ৩১ এবং ২০২৪ সালে ৩৬ জনের প্রাণ কেড়েছে সড়ক-মহাসড়ক। গত দুই বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে এবার সংখ্যা আরও বেড়েছে। এবারের ঈদের সবকিছু যখন আনন্দ ও স্বস্তিদায়ক ছিল, তখন ছুটির আনন্দ সড়কে প্রাণহানির কাছে যেন পরাস্ত হয়েছে।
৩ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘ছুটির আনন্দ সড়কে বিলীন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ চিত্র। প্রতিবেদন বলছে, ঈদযাত্রায় নসিমন, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং মোটরসাইকেলের চলাচল বেড়ে যায়। ঘরমুখো মানুষ দ্রুত বাড়ি যাওয়ার জন্য গণপরিবহন না পেয়ে বিকল্প হিসেবে এসব বাহন ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশের সড়ক অবকাঠামোর উন্নতি ঘটলেও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই কমছে না দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে দুই ও তিন চাকার গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকা, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধ চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার এবং মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো। এসব যানবাহন সড়ক ও মহাসড়কে নিয়ম মেনে চলে না। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বারবার নানা পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করা হলেও তা যে কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, প্রতিনিয়ত ঘটনা দুর্ঘটনাগুলোই এর প্রমাণ।
বাংলাদেশে সড়কে মৃত্যু প্রাত্যহিক ঘটনা। দিনের পর দিন সড়কে প্রাণহানি চলছে, অথচ তার দায়িত্ব নেওয়ার যেন কেউ নেই। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকদের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়; যা প্রকারান্তরে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ এ বাস্তবতা সামনে রেখে বলতে হয়, সংসারের প্রধান উপার্জনকারীর এভাবে বিদায়ে অনেক পরিবারকে পথে নামতে হচ্ছে। আবার পঙ্গুত্ববরণ করা ব্যক্তিরাও পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আমরা মনে করি, দুর্ঘটনা কমাতে হলে এর কারণগুলো সামনে রেখে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। মহাসড়কে সব অবৈধ পরিবহন বন্ধ করতে হবে। মানুষের বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে ভালো পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক-মহাসড়ক যানবাহন চলাচল উপযোগী করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ চালক দ্বারা যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। আইনের প্রয়োগ যথাযথ করার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সড়কে এমন মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগ কাগজকলমে সীমাবদ্ধ থাকলে দুর্ঘটনা কমবে না।
সড়ক দুর্ঘটনা এখন কার্যত জাতীয় সমস্যাভুক্ত। এ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যেটি জরুরি তা হচ্ছে যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ। আর এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মোটরসাইকেল চালকদের জন্য হেলমেট বাধ্যতামূলক পরার নিয়ম রয়েছে অথচ তার যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না। আবার একই রোডে ধীরগতির ও দ্রুতগতির সব ধরনের গাড়ি চলাচল করে। এর ফলে একদিকে যেমন জ্যামের সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও প্রবল হয়। এজন্য ধীরগতির ও দ্রুতগতির গাড়ির আলাদা লেন তৈরি করা যেতে পারে। চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি-না এ বিষয়টি নিয়মিত হালনাগাদ করা জরুরি। প্রয়োজনে চালকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আর এসব দেখার দায়িত্ব যাদের সেই প্রশাসনকে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বড় ধরনের সংকট নিয়ে আসে। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে বা পঙ্গু হয়ে গেলে সেটা সেই পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। অনেক ক্ষেত্রে সে দায় স্বজনদের সারাজীবন বহন করতে হয়। আহত ব্যক্তিরাও একসময় নিজের কাছে, এমনকি পরিবারের কাছেও বোঝা হয়ে যান। তাই সড়কে মৃত্যু হার কমাতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আমরা মনে করি, সুপ্রশিক্ষিত চালক, সড়কে সুব্যবস্থাপনা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন এবং তা কার্যকরের মাধ্যমেই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। আশা করি অবিলম্বে কর্তৃপক্ষ সুদৃষ্টি দেবেন।