সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৩:৫৮ পিএম
মানুষের সৌন্দর্যসচেতনতা বাড়ায় বাড়ছে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার। বাড়ছে এর চাহিদাও। চাহিদার বিপরীতে ভেজাল, নকল, মানহীন, অনুমোদনহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী সামগ্রীও দৃশ্যমান। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিশ্বমানের ব্র্যান্ডও। পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে নকল প্রসাধনীতে সয়লাব রাজধানী। সুদৃশ্য মোড়কে নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীও নকল করে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন বাজার ও সুপার মার্কেটে। মোড়ক দেখে বলার উপায় নেই কোনটা আসল কোনটা নকল। এভাবে অসাধু কারবারিরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব নকল প্রসাধনী ব্যবহার করে প্রতারিত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে ভোক্তাসাধারণ। দেশে কসমেটিকস আইন প্রণয়ন হলেও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে এ শিল্পের বাজার। ২৮ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘নকলের দখলে প্রসাধনীর বাজার, ঝুঁকিতে ক্রেতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে কিছু অসাধু চক্রের সমন্বয়ে এসব ভেজাল পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এসব নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা। চরম গোপনীয়তায় এখানে চলে নকল পণ্য উৎপাদনের মহোৎসব। তারপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকাসহ সারা দেশে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল ও মানহীন পণ্য ব্যবহার করে একদিকে ভোক্তারা যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন, তেমন ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেজাল ও নকল প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে কসমেটিকস পণ্য উৎপাদিত হলেও এসবের মানোন্নয়নে গুরুত্ব খুব একটা দেওয়া হয়নি। ভোক্তাস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হলেও সেদিকে কোনো তোয়াক্কা ছিল না সনাতন কোম্পানিগুলোর। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরের প্রসাধনী বাজারের ৪৫ শতাংশ পণ্যই মানহীন। এর একটা অংশ ব্রাজিল, ভারত ও চীন থেকে আসে; যা পাইকারি বাজার, ফুটপাত এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, নিম্নমানের প্রসাধনীতে ব্যবহৃত রাসায়নিক যেমন লেড, পারদ, ফরমালডিহাইড, আর্সেনিক ও স্টেরয়েড ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা অ্যালার্জি, ব্রণ, একজিমা, ত্বকের ক্যানসারের কারণ। নকল প্রসাধনীর রাসায়নিক স্নায়ুতন্ত্র ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।
প্রসাধনীর বাজার নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)-এর গবেষণায় জানা যায়, দেশে কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি করে। বাকি ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনীর বাজার চোরাকারবারি ও নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের দখলে। আমদানি ও উৎপাদিত প্রসাধনীর ৭০ শতাংশই থাকে মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিদেশি কসমেটিকস বৈধ পথে আমদানির চেয়ে চোরাই পথে বেশি আসে। বিএসটিআই বলছে, ২ রোজা থেকে এখন পর্যন্ত ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। এ সময় শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, হেয়ার অয়েল, স্কিন প্রোডাক্টসহ দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসেও ভেজাল পাওয়া গেছে। নামিদামি হেড অ্যান্ড শোল্ডার, প্যানটিনসহ এ ধরনের অনেক প্রোডাক্টেই দেখা যায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত সিল নেই; যা খুব বিপজ্জনক ক্রেতার জন্য।
ওষুধ ও কসমেটিকস আইন, ২০২৩-এর ২(৮) ধারায় প্রসাধনীর সংজ্ঞা এবং পঞ্চম অধ্যায়ের ৩১-৩৫ ধারায় প্রসাধনীর উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স, নিবন্ধন এবং বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে। আইনটিতে নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডসহ ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আইনটি পাস হওয়ার এক বছর অতিক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা দেশের মানুষকে রক্ষা করতে আইনের কার্যকর প্রয়োগ লক্ষ করা যায়নি। এসবের বিরুদ্ধে অভিযান, গ্রেপ্তার, মামলা বা জরিমানাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথাও শোনা যায়নি। ফলে নকল-ভেজালকারী ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। আমরা মনে করি, পরিস্থিতি উত্তরণে ওষুধ ও কসমেটিকস আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।
প্রকাশিত সংবাদটি দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। আমাদের সমাজে যে অসততাগুলো ভিত্তি পেয়েছে, তারই একটি উদাহরণ মাত্র। এ তালিকায় রয়েছে ভেজাল প্রসাধনী, রয়েছে মানহীন প্রসাধনীর বিষয়টিও। বাস্তবতা হচ্ছে, এ ভেজাল আর মানহীন প্রসাধনীর পাহাড় ডিঙিয়ে সবার পক্ষে ভালো প্রসাধনী সামগ্রীর নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। ফলে অর্থের ক্ষতির পাশাপাশি ত্বকের ক্ষতিও হচ্ছে সাধারণ মানুষের। যেকোনো উপায়ে এই চক্রটির কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে, এদের প্রতিহত করতে হবে। অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধের শাস্তি হলে অপরাধ কমে, অপরাধীরা সতর্ক হয়। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যারা এদের কর্মকাণ্ড নস্যাৎ করার দায়িত্ব নেবে, তারাই আবার কোনো কারণে এদের রক্ষক হয়ে যায় কিনা। কারণ, শর্ষের ভেতর ভূত দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের মনে রাখা দরকার, এ সমস্যা শুধু ব্যক্তিপর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়, এটি পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। তাই যেকোনো মূল্যে নকল প্রসাধনী উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে হবে।