দুলাল আচার্য
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৩:৫৪ পিএম
‘অভিযান-জরিমানায়ও বন্ধ হচ্ছে না ইট পোড়ানো’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ২১ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বান্দরবান জেলায় উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে ২৮টি ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর চিত্র উঠে আসে। যার কোনোটির নেই বৈধ লাইসেন্স। এসব ইটভাটায় দিনরাত উঠছে ধোঁয়া। পুড়ছে বনের কাঠ। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়, ফসলি জমি। কখনওসখনও লোকদেখানো অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করা হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না একটি ইটভাটাও।
২ মার্চ অন্য একটি দৈনিকের ‘অভিযানে বন্ধ, চলে গেলেই চালু হয় অবৈধ ইটভাটা’ শিরোনামের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে একই ধরনের চিত্র। জানা গেছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ছয়টি ইটভাটা রয়েছে। ভাটাগুলোকে নিষিদ্ধ ড্রাম চিমনি ব্যবহারসহ নানা অভিযোগে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভবিষ্যতে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভাটা পরিচালনা না করার বিষয়ে মুচলেকাও দেন মালিকরা। কিন্তু অভিযান চলে যাওয়ার পর ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা। ভাটাগুলোয় কাজ চলছে, এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত ড্রাম চিমনিতে কাঠ পোড়ানোর দৃশ্যও চোখে পড়ে। উল্লেখ্য, সব ভাটার চারপাশে কৃষিজমি। স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রতি বছর উচ্ছেদের নামে কার্যত নাটক করে প্রশাসন। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
অন্য আরও একটি দৈনিকে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার জোলাগাতি গ্রামে একটি ইটভাটায় ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে সনাতন পদ্ধতিতে কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স না নিয়ে ভাটাটিতে ইট পোড়ানো হচ্ছে। বিগত সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন দুই দফা অভিযান চালিয়ে ভাটা মালিককে জরিমানা করার পরও পুনরায় কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এ ধরনের কাঠ পোড়ানোর চিত্র সমগ্র দেশের- যা গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হয়ে আসছে। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট কালো ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশ করছে দূষিত। উজাড় হচ্ছে বনজ ও ঔষধিসহ বিভিন্ন বৃক্ষ। ফলে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। এ কারণে শুধু বাতাস নয়, ইটভাটা মাটি, পানি ও বনের ক্ষতি করে থাকে। ইটভাটার আশপাশ এলাকার মানুষ চর্ম, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সর্বোপরি ইটভাটাগুলোর কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর পরিবেশদূষণের প্রমাণও পাওয়া গেছে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই অবকাঠামো নির্মাণকাজে ব্যবহার হয়ে আসছে ইট। ইট তৈরির প্রধান কাঁচামাল কাঁদামাটি। তবে এ কাঁদামাটি মজবুত ও ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন প্রচুর জ্বালানি; যা আসে মূলত কয়লা ও কাঠ থেকে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচার উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে জমি। অথচ ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা কয়লা। কিন্তু বেশিরভাগ ভাটায় লোকদেখানো কিছু কয়লা ভাটার পাশে রেখে গোপনে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। অনেকে আবার প্রকাশ্যেই কাঠ ব্যবহার করছেন।বহু ভাটার ইট পোড়ানো চুল্লির চারপাশে ফেলে রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ কাঠ। জানা গেছে, কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ালে ১ লাখ ইটের জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হয় মাত্র ১৬ হাজার টাকা। আর প্রথম শ্রেণির ১ লাখ ইটের বিক্রয় মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু ইট পোড়াতে সামান্য এ অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে ক্ষতি করা হচ্ছে পরিবেশের। এসব কাঠের অধিকাংশই আসছে স্থানীয়ভাবে বন থেকে। অথচ জ্বালানি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ। বলা হচ্ছে, কয়লার দুষ্প্রাপ্যতা এবং কাঠের সহজলভ্যতার কারণে কাঠের ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলেছে। ফলে উজাড় হচ্ছে বন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, এসব দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের তারা যেন কিছুই দেখছেন না।
২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘ইট পোড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার বেআইনি।’ তবু ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া হয় না আইনি কোনো ব্যবস্থা। অভিযোগ আছে, ইটভাটা মালিকরা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই প্রকাশ্যে এসব চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আইন পরিবেশ রক্ষা ও বায়ুদূষণ কমানোর জন্য জরুরি। তাই এর যথাযথ প্রয়োগ যাতে হতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কঠোর হওয়া জরুরি।
পরিসংখ্যান বলছে, ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ৮ হাজার ৩৩টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৫১৩টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। অর্থাৎ এ ইটভাটাই অবৈধ। গড়ে প্রায় তিনটি ইটভাটার মধ্যে একটিই অবৈধ। এ কাঠ পোড়ানোর ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। নির্বিচার গাছ নিধন জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। পরিবেশদূষণ রোধে সরকার ২০১২ সালে ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিলেও তা কাজে আসেনি। সারা বিশ্ব যেখানে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের দিকে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে, সেখানে দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক বৃক্ষনিধন দিনদিন বেড়েই চলেছে।
একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে যেখানে মোট আয়তনের ২৫% বনভূমির প্রয়োজন, সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ১৩% বন অবশিষ্ট রয়েছে। এই তথ্য, জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (ফাও)-এর। আশঙ্কা রয়েছে বনাঞ্চল থেকে কাঠ এনে এভাবে অবাধে ইটভাটায় পোড়ানো হলে অচিরেই হয়তো ধ্বংস হতে পারে অবশিষ্ট বনাঞ্চলও। অন্যদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ২২৫ হেক্টর এবং বছরে ৮২ হাজার হেক্টর ভূমি নষ্ট হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আবাসন ও ইটভাটার জন্য মাটি সংগ্রহ করা।
অবৈধ ইটভাটাগুলো কেন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায় না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। স্থায়ীভাবে বন্ধ না হওয়ার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আদালতের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও ইটভাটাগুলো বন্ধ করা যাবে না। আমরা মনে করি, স্থায়ীভাবে বন্ধের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরই ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে পরিবেশ অধিদপ্তরও। প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আদালতÑ সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলেই আমাদের পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে।
মনে রাখতে হবে, আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা। তাই ইটভাটায় গাছ পোড়ানো বন্ধ হওয়া উচিত। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিগগির সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পদক্ষেপ নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ফাঁপা এবং না-পোড়ানো ইটের ব্যবহার হচ্ছে, আমরাও সে পথে যেতে পারি। পোড়ানো ইটের ব্যবহার কমিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ইট ব্যবহারের প্রচলন করা হোক। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু রাষ্ট্রীয় সচেতনতাই নয়, ব্যক্তিপর্যায়েও জনসচেতনতা জরুরি। পাশাপাশি ইটভাটাসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করতে হবে।