প্রবাসে ঈদ
নিরঞ্জন রায়
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৫ ১১:৩৩ এএম
নিরঞ্জন রায়
আমরা যারা আটলান্টিকের অন্য প্রান্তে বসবাস করি, তারা একদিকে সৌভাগ্যবান। কেননা এখন বিদেশ আর কোনোভাবেই দেশ থেকে দূরে মনে হয় না। এখন মনে হয় দেশেরই কোনো একটি শহরে বসবাস করছি। অথচ মাত্র পনের-বিশ বছর আগেও অবস্থা এমন ছিল না। আমাদের অগ্রজদের ভাষ্যমতে সে সময় বিদেশকে মনে হয়েছে দেশ থেকে অনেক দূরে বিশ্বের এক দুর্গম অঞ্চলে পড়ে থাকার মতো। দেশের মানুষের সঙ্গে খুব একটা দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না। দেশের কোনো খাবারদাবার বা অন্য কোনো ব্যবহারোপযোগী জিনিসপত্র একেবারেই পাওয়া যেত না। এখন অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রচুর বাংলাদেশি এ টরন্টো শহরে বসবাস করেন। নির্দিষ্ট কিছু এলাকা এতটাই বাঙালি-অধ্যুষিত যে সেসব স্থান বাঙালি এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ রকম একটি এলাকা হচ্ছে টরন্টো শহরের ড্যানফোর্থ, যা বাঙালিপাড়া নামে বেশ পরিচিত। টরন্টো শহরে যত বাঙালি বসবাস করে, তার অধিকাংশ থাকে এ অঞ্চলে। এ এলাকায় গেলে মনে হবে যে সিলেটের বিয়ানীবাজার বা অন্য কোনো শহরে আছি।
এত বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করায় এখন প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। এখানে বাঙালি মালিকানাধীন অনেক দোকান গড়ে উঠেছে, যেখানে বাংলাদেশের হেন জিনিস নেই, যা পাওয়া যায় না। কাচকি মাছ থেকে শুরু করে খেজুরের গুড় সবকিছুই এখানে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন এমন জিনিসও এখানে খুব সহজেই পাওয়া যায়। দাম যথেষ্ট বেশি। কিন্তু পাওয়া যায় সবই। প্রযুক্তির বদলে এখন টরন্টোর ঘরে বসে বাংলাদেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল দেখা যায়, সব পত্রিকা পড়া যায়, হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জারে দেশের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সারাক্ষণই কথা বলা যায়। ফলে এ টরন্টো শহরকে এখন আর কোনোভাবেই বিদেশ মনে হয় না। একবার বাংলাদেশ থেকে এক আত্মীয় আমার বাসায় বেড়াতে এসে তো বলেই ফেললেন, ‘আপনার বাসায় থাকা আর ঢাকায় থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ আমি যখন জানতে চাইলাম কেন এমন মনে হলো, তখন তিনি জানালেন, ‘আপনার বাসায় সারাক্ষণ বাংলায় কথাবার্তা, বাংলা টেলিভিশন দেখা, বাংলা পত্রিকা পড়া, হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জারে যখন খুশি তখন দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং কাঁচকি মাছ ও মসুর ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া যায়। আমাদের ঢাকায় জীবন এখন এ রকমই।’ আমি তার সঙ্গে আর কথা না বাড়ালেও এটুকু বুঝলাম এখন বিদেশে আমাদের প্রবাসজীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে, বিশেষ করে দেশের মতোই বসবাসের সুযোগ হয়েছে।
এ টরন্টো শহরে সব ধর্মীয় উৎসব এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মতোই যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। তবে উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে কর্মসংস্কৃতির গুরুত্ব এবং প্রাধান্য থাকায় মানুষ কাজের সময় কাজ আর অন্য সময় অনুষ্ঠান এবং আনন্দ উৎসব করে থাকে। এভাবেই এখানকার সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং মানুষ এ কালচারে অভ্যস্তও হয়ে গেছে। অবশ্য এখানে ওয়ার্কলাইফ ব্যালান্স বা কাজ এবং জীবনযাপনের মধ্যে সুন্দর একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করার ব্যাপারেও বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উন্নত বিশ্বে কোনো অনুষ্ঠান যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে না হয়, তাহলে সেটা আর সেভাবে জমে না। তারপরও সাপ্তাহিক কাজের দিনে কোনো অনুষ্ঠান হলে সেটা উদ্যাপনে এখন আর সেভাবে সমস্যা হয় না। কারণ ওয়ার্কলাইফ ব্যালান্সকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার করণে যে-কেউ চাইলে আগে থেকে কিছুটা পরিকল্পনা করে সব অনুষ্ঠানই তিথি মোতাবেক উদ্যাপনের সুযোগ পায়। এরপরও সাপ্তাহিক কর্মদিবসে অনুষ্ঠানের তিথি পড়লে সেদিন আর স্বাভাবিক উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে সে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে ওঠে না। অনেকে আগে থেকে ছুটি নিতে পারলেও সবাই যে পারেন, তেমন নয়। তাছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশটাও সেভাবে সৃষ্টি হয় না। দেখা যায় কর্মদিবসে ঈদ অনুষ্ঠিত হলে বেশিরভাগ সময় ঈদের আনুষ্ঠানিকতা, বিশেষ করে ঈদের নামাজ এবং নিকট আত্মীয়স্বজনের বাসায় দাওয়াত খাওয়ার মধ্যেই সীমিত হয়ে যায়। বাকি আয়োজন অর্থাৎ পরিচিত সবার বাসায় দাওয়াত খাওয়া, ঈদের পার্টি, বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। অবশ্য ঈদ যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে এখানে উদ্যাপনের মাত্রা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়।
ঈদ উপলক্ষে প্রবাসে নতুন জামাকাপড় কেনার খুব যে ধুম পড়ে, তেমন নয়। কারণ এখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। তাই সারা বছর ধরে যখন প্রয়োজন তখনই সব ব্র্যান্ডের পোশাক কিনতে পারে। ফলে আমাদের দেশের মতো ঈদ উপলক্ষে বিশেষভাবে জামাকাপড় কেনার হিরিক পড়ে না। তার পরও ঈদ বলে কথা। নতুন পাঞ্জাবি, শাড়ি এবং সালোয়ার-কামিজ না হলে ঈদ জমে না। ঈদের আগ দিয়ে বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় বেশ কয়েকটি কাপড়ের দোকান বেশ জমে ওঠে। পাশ্চাত্য শহরে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখানকার পাস্তা, বার্গার এবং স্যান্ডুইচ খাবারের সঙ্গে অভ্যস্ত হলেও ঈদ উপলক্ষে ঠিকই সেমাই, জর্দা, কোরমা-পোলাওয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। এ কারণেই ঈদের দিন এ প্রবাসেও ঘরে ঘরে বিশেষ খাবার, সেমাই, জর্দা, কোরমা-পোলাও রান্না হয় এবং সবাই তৃপ্তিসহকারে সেসব খাবার উপভোগও করে।
বিশ্বের সর্বত্রই আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন একশ্রেণির মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ, যদিও তারা সংখ্যায় খুব কম। আরেক শ্রেণির মানুষ আছে যাদের ন্যূনতম জীবনধারণের অর্থও হাতে নেই এবং তারাই সমাজের বৃহত্তম অংশ। এ অবস্থা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেমন ব্যাপকভাবে বিদ্যমান, তেমন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মতো উন্নত দেশেও লক্ষ করা যায়। এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে উৎসব অনুষ্ঠানে। আমাদের দেশে কিছু মানুষ যারা ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে চলে যায় কক্সবাজার, কুয়াকাটা এবং অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে। এমনকি অনেকে চলে যায় দেশের বাইরে। অথচ সমাজের একটি অংশ ঈদের দিন সেমাই পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না। এ রকম একটা অবস্থা এ টরন্টো শহরেও লক্ষ করা যায়। কিছু মানুষ ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে চলে যায় বিভিন্ন দেশে যেমন দ্বীপদেশ কিউবা, মেক্সিকো, বাহামা প্রভৃতি পর্যটনকেন্দ্রে। আবার কিছু মানুষ আছে যারা দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য ঈদের দিনও কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব আর্থসামাজিক অবস্থার কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা থাকলেও, ঈদের আনন্দ এ প্রবাসে বেশ ভালোই জমে ওঠে।
টরন্টো শহরে ঈদ উদ্যাপনের এক বিশেষ আয়োজন আছে যা একেবারেই ভিন্ন মাত্রার এবং স্বতন্ত্র। এখানে ড্যানফোর্থ বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় চাঁদরাতের, অর্থাৎ ঈদের আগের রাতে এক বিশেষ আয়োজন করা হয়। এখানে হাজার হাজার বাঙালি সমবেত হয় ঈদের আগের রাতে বিশেষভাবে আনন্দফুর্তি করে কাটানোর জন্য। টরন্টোর আশপাশের শহর থেকেও এখানে মানুষ আসে শুধু চাঁদরাতের আনন্দটুকু উপভোগ করার জন্য। ড্যানফোর্থ লোকারণ্য হয়ে যায়। গাড়ি রাখার বিশাল স্থানে তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। এত মানুষের সমাগম যে ঠিকমতো হাঁটাচলা করা যায় না। মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে মেহেদি লাগাতে ব্যস্ত, হরেকরকমের খাবারের দোকান ভরে যায়। লাউড স্পিকারে যেমন গান বাজতে থাকে, তেমন মানুষের নাচানাচির দৃশ্যও চোখে পড়ার মতো। এ বিশেষ আয়োজনে সব ধর্মের মানুষই এসে থাকে। আমি নিজে বেশ কয়েকবার এ আয়োজন উপভোগ করতে গেছি। আমার মেয়েরাও এ মাত্রার উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে অভিভূত। আমার বড় মেয়ে তো বলেই ফেলল, ‘আমি অনেক মাল্টি কালচারাল অনুষ্ঠানে গেছি, কিন্তু কোথাও এ মাত্রার উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখিনি।’
আসলে আমাদের দেশে যেমন সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানই বেশ সর্বজনীনভাবে উদ্যাপিত হয়, টরন্টোতেও তা-ই। এখানে যখন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু ভাষার, বহু ধর্মের মানুষের সঙ্গেই হয়ে থাকে। যেমনটা হয় ক্রিসমাস, দুর্গাপূজা, দিওয়ালি এবং চায়নিজ নিউইয়ারের সময়। উৎসবের আনন্দও সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নেয়। আমার বেশ কিছু সহকর্মী এবং বন্ধু আছে যারা তুরস্ক, মিসর এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছে। আমি যখন তাদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাই, তখন তারা কিছুটা অবাক হয়। আমার কাছে জানতে চায় আমি কীভাবে সঠিক সময়ে শুভেচ্ছাটা পাঠাতে পারি। তাদের জানিয়েছি যে আমি যে দেশে জন্মগ্রহণ করে বেড়ে উঠেছি, সেখানে ধর্মীয় উৎসব এভাবেই পালিত হয়। বিনিময়ে তারাও আমাকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানায়। কিন্তু দুর্গাপূজা যেহেতু শুধু বাঙালি হিন্দুদের অনুষ্ঠান, তাই বিশ্বব্যাপী সেভাবে পালিত হয় না, যেমনটা হয় ঈদ, দিওয়ালি, ক্রিসমাস এবং চায়নিজ নিউইয়ার। তাই দুর্গাপূজা মনে রেখে তারা আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে পারে না। তবে দিওয়ালি উপলক্ষেই তারা আমাকে শুভেচ্ছা জানায় এবং আদের আন্তরিকতাকে সম্মান করে আমি সেটা খুশিমনেই গ্রহণ করি। প্রবাসে থাকলেও পাশ্চাত্যের এ টরন্টো শহরে যেভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করা হয় এবং সেখানে সব ধর্মের মানুষ যেভাবে সে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়, তাতে এ প্রবাসেও এটা প্রমাণিত যে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। সবাইকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা।