× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ব্যাংকিং অর্থনীতি

কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫ ১১:০০ এএম

নিরঞ্জন রায়

নিরঞ্জন রায়

আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এ খাতের মান উন্নয়নের জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। কেননা দেশের ব্যাংকিং খাত অনিয়ম এবং অব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে- ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার, পরিবর্ধন এবং পরিবর্তন ছাড়া দেশের অত্যাবশ্যিক এ খাত মানসম্পন্ন একটি পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব নয়। বিশেষ বিশেষ সমস্যা চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্নভাবে সেসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলে, তা খুব কাজে আসবে না। আগে এ রকম কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে রকম কোনো প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। যেমন অতীতে গৃহীত এফএসআরপি বা ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রোগ্রাম এবং ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা সিআরএম (ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট) এবং এএলএম (অ্যাসেট লায়াবিলিটি ম্যানেজমেন্ট) সে রকম কোনো সফলতা দিতে পারেনি।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার প্রয়োজন এ কথাটি যেমন বাস্তব সত্য, তেমন এ সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবিও দীর্ঘদিনের। বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বেশ স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও মানোন্নয়নের বিষয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন তাদের মধ্যে বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অন্যতম। কিন্তু এ ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ব্যাপারে গভর্নরের একদিনের এক মন্তব্য ছাড়া বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি এ ব্যাপারে সে রকম কোনো আলোচনাও আর চলছে না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে দেশ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। আগে থেকেই কিছু সমস্যা বিদ্যমান ছিল। পরিবর্তিত অবস্থার কারণে আরও নতুন নতুন জটিল সমস্যা এসে জেঁকে বসেছে। সমস্যার মাত্রা এবং অগ্রাধিকারের তালিকা এত লম্বা ও জটিল আকার ধারণ করেছে যে- এর সঠিক সমাধান খুঁজে বের করতে অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর, উভয়ের দিশাহারা অবস্থা। সত্যি বলতে কি, স্মরণকালের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে, যা মোকাবিলা করা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর, নব্বইয়ের দশকের স্বৈরাচার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ রকম কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছিল। খুবই সঠিক কথা এবং এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো অবকাশ নেই। তবে পার্থক্য হচ্ছে তখন দেশের মানুষ উন্নত অর্থনীতি বা জীবনযাত্রার স্বাদ নিতে শেখেনি। এখন মানুষ এ রকম কিছু সুযোগসুবিধা পেয়ে তাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। পনের বছরের শাসনামলের পরিবর্তন, বিশেষ করে যারা এতদিন অনেক ভালো ভালো কথা শুনিয়েছেন এবং যাদের ওপর মানুষের আস্থা অনেক বেশি, তারা অন্তর্বর্তী সরকারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মানুষের এ প্রত্যাশা আরও অনেক বেড়ে গেছে। এ আকাশচুম্বী প্রত্যাশার যদি ন্যূনতম পূরণ করা সম্ভব না হয়, তখন এ মানুষদেরই হতাশ হতে এক মুহূর্ত লাগবে না।

দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের স্বচ্ছ ধারণা আছে তাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেই এ ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সবার আগে প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা বা স্কোপ অব ওয়ার্ক নির্ধারণ করা

সঙ্গত কারণেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনেক তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হয়তো ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকার নিচে পড়ে গেছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অন্যান্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। কেননা ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং মানোন্নয়নের ওপর নির্ভর করে বিরাজমান অন্য সমস্যাগুলোর সন্তোষজনক এবং টেকসই সমাধান। যেমন বিদ্যমান ডলারসংকটের সমাধান, আমদানি-রপ্তানি সহজ করা, আমদানি ব্যয় হ্রাস করা, দেশে তারল্যসংকটের সমাধান, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, ব্যবসায় গতি ফেরানো, অর্থনীতির চাকা সচল রাখাসহ যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোর সঠিক সমাধান করতে হলে মানসম্পন্ন ব্যাংকিং খাত নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমান অর্থনীতি যত না অর্থনীতির তত্ত্বনির্ভর, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাংকনির্ভর। সমগ্র বিশ্বেই এখন অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অর্থনীতিবিদদের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখেন ব্যাংকার, মানি ম্যানেজার এবং মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ। এখন যুক্তরাষ্ট্রে একজন অর্থনীতির অধ্যাপকের চেয়ে ওয়ারেন বাফেটের মন্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ওয়ারেন বাফেট একজন প্রখ্যাত মানি ম্যানেজার বা হেজ ফান্ড সম্রাট ছাড়া আর কিছুই নন। এখনকার মূল কথাই হচ্ছে দেশের অর্থনীতি ভালো রাখতে হলে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। বর্তমান অর্থনীতির এ মৌলিক সূত্রটি চীন খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও তারা একটি মানসম্পন্ন ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ব্যাকিং কমিশন গঠন করতে হবে, এটা যেমন বাস্তবতা, তেমন যেনতেনভাবে একটি কমিশন গঠন করা হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, বরং এতে জটিলতা আরও বাড়বে। এ ব্যাপারে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। অতীতে ব্যাংকিং কমিশন না হলেও, এর কাছাকাছি দুয়েকটি উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি তেমন নয়। যেমন গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি বিদেশি কনসালট্যান্টদের সমন্বয়ে ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রোগ্রাম, যা সংক্ষেপে এফএসআরপি নামে পরিচিত, সে রকম একটি ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল দেশের ব্যাংকিং খাতের মানোন্নয়নে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাংকগুলোর ত্যাগ করা সিএল বা ক্লাসিফিকেশন অব লোনস গ্রহণ করা হয়েছে, যা মূলত দেশের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ সমস্যার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ দেশে যে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ এবং প্রতিটি ব্যাংকে যে ব্যাপক প্রভিশন ঘাটতি, তার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এ সিএল।

অনেকেই বলে থাকেন এবং আমিও মনে করি যে, সেই এফএসআরপি নামের সংস্কার কর্মসূচির একমাত্র সফলতা হচ্ছে সিআইবি অর্থাৎ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো। সেখানেও কথা আছে। যখন ক্রেডিট ইনফরমেশন এবং ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিংয়ের ওপর ভিত্তি করে ক্রেডিট এবং ঋণগ্রহীতার রেটিং পদ্ধতির প্রচলন হওয়ার কথা, তখন আমরা সিআইবি নিয়েই পড়ে আছি। একইভাবে এ শতাব্দীর শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০০৩-০৪ সময়ের দিকে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা সিআরএম (ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট) কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সঠিকভাবে সিআরএম বাস্তবায়নের অর্থই হচ্ছে বেনামি ঋণ বা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর বন্ধ করা এবং খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হ্রাস পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে তা সবারই জানা। এতেই বোঝা যায় সিআরএম বাস্তবায়নের নামে বিদেশি কনসালট্যান্টরা তাদের পারিশ্রমিক নিয়ে চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতের কোনো লাভ হয়নি।

এসব কারণে এবার যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের আলোচনা চলছে সেটি করতে হবে যথেষ্ট ভেবেচিন্তে এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে, যাতে কমিশনটি শক্তিশালী এবং কার্যকর হয়। দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের স্বচ্ছ ধারণা আছে তাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেই এ ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সবার আগে প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা বা স্কোপ অব ওয়ার্ক নির্ধারণ করা। আমরা সবাই ব্যাংকিং খাতের সমস্যার কথা বলি, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে যখন সমস্যাগুলো জানতে চাওয়া হয়, তখন দুয়েকটির বেশি আর কেউ কিছু বলতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব এবং খেলাপি ঋণকেই সমস্যা হিসেবে দেখেন। কিন্তু এ দুটি বিষয় সমস্যা হলেও, এগুলো অন্যান্য মূল সমস্যার ফল। তাই এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সঠিকভাবে এবং বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণ করে দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার সহজ হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকব্যবস্থা একটি পর্যায়ে উন্নীত করার কাজটিও সম্ভব হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শুরু থেকে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে মানসম্পন্ন পরিচালনব্যবস্থা এবং আধুনিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন করা হয়নি। চালু করা হয়নি আধুনিক ব্যাংকিং প্রোডাক্ট এবং সেবা। ফলে সংখ্যার দিক থেকে ব্যাংক বৃদ্ধি পেলেও মানের দিকে থেকে পিছিয়েছে। পক্ষান্তরে বিশ্বে ব্যাংকিং কার্যক্রমের ব্যাপক আধুনিকায়ন ঘটেছে। সম্পূর্ণ ডিজিটাল বা কাগজবিহীন ব্যাংকিং এখন বাস্তবতা। এমনকি ব্যাংকিং সেবা ও প্রডাক্টে এসেছে বৈচিত্র্য এবং আধুনিকতা। একসময় সঞ্চয় সংগ্রহ এবং ঋণ প্রদান ছিল ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কার্যক্রম, যা এখনও আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান ও একমাত্র কার্যক্রম। অথচ উন্নত দেশে এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকে এ দুটি সেবা এখন অনেক নিচের সারির কাজ। এসব কারণেও বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না আমাদের দেশের ব্যাংকিং। এ কারণেই উন্নত বিশ্বের ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যাংকের লেনদেন সম্পর্ক রাখতে বেশ সমস্যা হয়। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার অপরিহার্য। আর সঠিকভাবে সংস্কার করতে হলে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

  • সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা