পর্যবেক্ষণ
মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫ ১০:৫৬ এএম
মযহারুল ইসলাম বাবলা
কোনো মানুষই সংস্কৃতিবিহীন নয়। সংস্কৃতি জাতীয়তার পরিচয়ন বহন করে। বলা বাহুল্য, জাতীয়তার প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা। ভাষাও সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ। ভাষা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ভাষাই আমাদের নিকটবর্তী করে তোলে। পরস্পরের যোগাযোগ, আদান-প্রদানে, চিন্তার বিনিময়ে ভাষার বিকল্প নেই। নিজ মাতৃভাষায় যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে-সাবলীলভাবে পরস্পরকে একাত্ম করতে পারে, ভিন্ন ভাষায় সেটা সম্ভব যদি হয়ও তবু প্রাণবন্ত হয় বলা যাবে না। তাই ভাষা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবেই যোগাযোগের, আদান-প্রদানের সর্বজনীন মাধ্যম।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ বাঙালি। পাশাপাশি কিছু ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষও এদেশে বসবাস করে। যাদের আমরা উপজাতি বলে থাকি। তারাও অনিবার্য রূপে জাতি। ক্ষুদ্র বলেই তুচ্ছতাচ্ছিল্যে মূলধারা বিচ্যুত উপজাতি বলে তাদের অবজ্ঞা করে থাকি। সেটা জাত্যভিমান ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তাদের জাতিসত্তাকে অবশ্যই আমাদের স্বীকার ও স্বীকৃতি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভিত্তিতে বিবেচনা করা অন্যায় বলেই মনে করি। নয়তো ক্ষমতার দাম্ভিকতায় পাকিস্তানি শাসক থেকে আমাদের পার্থক্যটা রইল কোথায়! ভাষা প্রতিটি জাতিসত্তার জন্মগত অধিকার। এই অধিকার হরণের অজস্র ঘটনা বিশ্বব্যাপী ঘটে চলেছে। ভাষার আধিপত্যে বিশ্বে জাতীয়তার সংকটে বিভিন্ন ভাষাভাষীরা আক্রান্ত পর্যন্ত হচ্ছে। যেমনটি আমাদের মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে উর্দু ভাষা চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরপরই। আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলাম, ত্যাগ আত্মত্যাগে। আমরা জয়ী হয়েছিলাম। বিশ্বের প্রচুর দেশে ভাষার সংগ্রাম কিন্তু চলেছে এবং ক্রমাগত চলছে।
জাতীয়তার মীমাংসাটা তাই প্রাথমিক। জাতীয়তার মীমাংসাকে অসম্পূর্ণ রাখার ফলে বহু দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর জাতি-বৈষম্যের ভিত্তিতে। জাতিগত নিপীড়নের মুখে বাধ্য হয়ে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম গণতান্ত্রিক এবং সশস্ত্র পন্থায় বিভিন্ন দেশে বিরাজ করছে।
আমাদের দেশে শহর এবং গ্রামের সুযোগ-সুবিধা থেকে সব ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যপূর্ণ অসংগতি রয়েছে। নাগরিক জীবনের সুযোগ আর প্রান্তিকের সুবিধাবঞ্চিত সামষ্টিক জীবনের বৈপরীত্য স্থূলভাবে ধরা পড়ে। এ যেন ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডের আদল। তাই গ্রাম ও শহরের বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার বৈপরীত্যের অবসান জরুরি
স্বীকার করতে হবে আমাদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, সশস্ত্র যুদ্ধ জয়ে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্র নয়। কেননা ক্ষুদ্র হলেও এখানে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতির মানুষ বসবাস করে, তাদের ভাষা সংস্কৃতিকে স্বীকার করে নেওয়া আমাদের কর্তব্য। আগেই বলেছি প্রতিটি ভূখণ্ডের মানুষের জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশকে তাই জাতিরাষ্ট্রের পরিচয়ে নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করতে হবে।
প্রশ্ন উঠবে একই জাতীয়তার মানুষের মধ্যকার বন্ধন কি তবে শ্রেণি নিরপেক্ষ? না, মোটেও না। জাতীয়তার থেকেও অগ্রবর্তী শ্রেণি। শ্রেণিই পারস্পরিক সম্পর্ক সম্প্রীতির প্রধান মাপকাঠি। জাতীয়তা নিকটবর্তী হওয়ার প্রাথমিক অনুষঙ্গ কিন্তু সামগ্রিক নয়। শ্রেণিগত অবস্থার ভিত্তিতেই সম্পর্ক-সম্প্রীতি গভীর ও সুদৃঢ় হতে পারে। জাতীয়তায় নয়। জাতীয়তা আমাদের যোগাযোগ, আদান-প্রদানের প্রধান মাধ্যম নিশ্চয়। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্প্রীতিতে শ্রেণির ভূমিকাই প্রধান। তাই জাতীয়তা শ্রেণি-নিরপেক্ষ নয়।
প্রতিটি জাতির জাতীয়তা এবং শ্রেণির ভিন্নতায় সংস্কৃতির রকমফের নিশ্চয় রয়েছে। তার পরও নিজ নিজ অবস্থানের ভিত্তিতে সংস্কৃতির বলয়ের মধ্যেই প্রত্যেকটি মানুষের অবস্থান বিরাজ করে। সংস্কৃতি স্থির অনড় নয়। সংস্কৃতির যুগ, কাল এবং অর্থনৈতিক কারণে বিবর্তিত হয়। তাই মানুষের আদিম সংস্কৃতি সভ্যতার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে, ভৌগোলিকভাবে সব দেশে ও সমাজে। প্রত্যেকটি জাতি নিজ নিজ ভূখণ্ডের সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে। ভাষাও যেমন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়, তেমনি সংস্কৃতিও। তাই সংস্কৃতি নির্দিষ্ট গন্ডিতে কখনও সীমাবদ্ধ নয়। সংস্কৃতি বিকাশমান। প্রতিনিয়তই সংস্কৃতির রূপ পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই সংস্কৃতির আদি বা অন্ত বলে বাস্তবে কিছু নেই। বস্তুত সংস্কৃতি শ্রেণি-নিরপেক্ষও নয়।
আমাদের ভূখণ্ডে অতীতে সেলাই করা জামার প্রচলন ছিল না। বাঙালি নারীদের শাড়ি পরনের প্রচলন প্রথম চালু করেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দ দেবী। পার্সি নারীদের শাড়ি পরতে দেখে তিনি প্রথম ঠাকুরবাড়িতে শাড়ি পরিধানের প্রচলন চালু করেছিলেন। পর্যায়ক্রমে সেই থেকেই বাঙালি নারীদের শাড়ি পরিধানের সূত্রপাত হয়। নারীরা শাড়ির ন্যায় লম্বা কাপড় জড়িয়ে পরত। পুরুষরা ধুতি এবং গায়ে চাদর। সেলাই বস্ত্রের সূত্রপাত হয়েছে বহু পরে এবং ভিন্ন দেশের বস্ত্র সেলাইয়ের অনুকরণে। সভ্যতা নিজ ভূখণ্ড থেকে গজিয়ে ওঠে না। সভ্যতার বাহন মানুষ এবং অভিবাসী প্রক্রিয়ায় সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ে এক দেশ, মহাদেশ থেকে অন্য দেশ, মহাদেশে। আমাদের খাদ্য সংস্কৃতিও একই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে বটে, তবে নিত্যই পরিবর্তিত হচ্ছে। খাদ্য, পোশাক, রুচির এই ক্রমপরিবর্তন ধারা সব জাতির ক্ষেত্রেই ঘটে।
আমার শৈশব-কৈশোরে চট্টগ্রামে গেলে দেখেছি আবালবৃদ্ধবণিতাদের পোশাক প্রতিবেশী মিয়ানমার দেশের বার্মিজদের আদলে। কোমর থেকে কয়েক ভাঁজ দিয়ে রঙ-বেরঙের কাপড় পেঁচিয়ে পরত। ওটাকে বলত থামি। ব্লাউজ পরত। ব্লাউজকে বলত কুর্তা এবং ওড়না গায়ে জড়িয়ে রাখত, সেটাকে বলত বড়কয়ড় [বড় কাপড়]। তিন ভাগে বিভক্ত পোশাক পরত প্রায় সব নারীই। তবে অগ্রসর শ্রেণি অর্থাৎ শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল শ্রেণির মুষ্টিমেয় নারীদের কেবল শাড়ি পরতে দেখেছি। চট্টগ্রামের স্থানীয় নারীদের পোশাক পরিধানে শ্রেণি বিভাজন ওই পোশাকের ভিন্নতার মধ্যে প্রকাশ পেত।
পরিবর্তনের ধারা কিন্তু সর্বজনীন তাৎক্ষণিক ঘটে, তা নয়। সমাজের সুবিধাভোগীদের বেলায় ঘটলেও সেটা প্রান্তিকে ঘটে না। এর প্রধানত কারণ অর্থনৈতিক। শহরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষের সাধ্য আর সামষ্টিক সাধারণের সাধ্য এক নয়। তাই আমরা শহুরে জীবনে সংস্কৃতির পরিবর্তন যেমন দ্রুত দেখে থাকি, প্রান্তিকে সেটা দেখা যায় না। যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব পরিবর্তনে এখন এক দেশের সংস্কৃতি অপর দেশে সহজে পৌঁছে যায়। অভিবাসীদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না এবং সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই। সমাজ, সভ্যতার রূপান্তর অনিবার্যরূপে সংস্কৃতিরও রূপান্তর। প্রান্তিকজনরা তাদের অর্থনৈতিক কারণে সংস্কৃতির রূপান্তরিত ধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না বা সেটা গ্রহণ করতে পারে না। তাই সমাজের সুবিধাভোগী এবং বঞ্চিত মানুষের সংস্কৃতির ভিন্নতা মোটাদাগে দৃশ্যমান। সেটা সব দেশ ও সমাজের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
সমাজের অগ্রপশ্চাৎ যে দুটি ধারা বিদ্যমান, সেটা শ্রেণিগত কারণেই। একই দেশ ও সমাজে সংস্কৃতির ভিন্নতার পেছনে শ্রেণির ভূমিকা অনিবার্য। শ্রেণিগত কারণে এখনও প্রান্তিকে সকালে পান্তা ভাত খাবার রেওয়াজ রয়েছে। সেটা আদি সংস্কৃতিকে ভালোবেসে নয়, অর্থনৈতিক কারণে। আমাদের দেশে শহর এবং গ্রামের সুযোগ-সুবিধা থেকে সবক্ষেত্রে চরম বৈষম্যপূর্ণ অসংগতি রয়েছে। নাগরিক জীবনের সুযোগ আর প্রান্তিকের সুবিধাবঞ্চিত সামষ্টিক জীবনের বৈপরীত্য স্থূলভাবে ধরা পড়ে। এ যেন ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডের আদল। তাই গ্রাম ও শহরের বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার বৈপরীত্যের অবসান জরুরি। তেমনি জরুরি শ্রেণিবৈষম্যের অবসানে অভিন্ন সংস্কৃতির বলয় গড়ে তোলা। স্বীকার করতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থাধীনে সেটা সম্ভব নয়। তাই ব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য। ব্যবস্থার পরিবর্তন আলাদীনের বাতির স্পর্শে ঘটবে না। সেজন্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। কাজটি নিশ্চয় রাজনৈতিক। পাশাপাশি সাংস্কৃতিকও বটে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিতে এগিয়ে এসে বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখবেন বলেই ভরসা করছি।