সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১১:২৫ এএম
দেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে ঘিরে যে অসন্তোষ চলছে- তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মাঝে কিছুদিন শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ থাকলেও এর কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। এই খাতটি কখনও বেতন-বোনাস-ভাতার দাবিতে, কখনও তৃতীয় পক্ষের উস্কানি; কখনও বা রাজনৈতিক কারণে অস্থিরতায় ভুগছে। সামনে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। শিল্পাঞ্চলখ্যাত গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই নানা দাবি নিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক দখল করে আন্দোলন করছে শ্রমিকরা। ঈদ সামনে রেখে এই মাত্রা অনেকগুণ বেড়েছে। সেখানকার বেশিরভাগ কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হয়নি বলছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। জানা গেছে, শিল্প-অধ্যুষিত গাজীপুর জেলায় ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি তৈরি পোশাকশিল্পের। রয়েছে ছোট ও মাঝারি বহু কারখানাও। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গাজীপুরে অর্ধশত শিল্পকারখানা বন্ধ ছিল। সম্প্রতি বেক্সিমকো ও কেয়া কারখানা মিলিয়ে আরও ২০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার কর্মহীন হাজার হাজার শ্রমিক মানবেতর দিন যাপন করছে। বন্ধ থাকা কারখানার এসব শ্রমিকের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়কে আন্দোলন করছে। ফলে প্রায়ই বন্ধ থাকছে গাজীপুরের মহাসড়কসহ প্রধান সড়কগুলো।
১৯ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘দাবি আদায়ে সড়কে শ্রমিকরা, ঈদযাত্রায় ভোগান্তি এবারও’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এই চিত্র। প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে ৬৪ দিন শ্রমিকদের কারণে উত্তাল ছিল গাজীপুর। এসব ঘটনার জেরে বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডও সংঘটিত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে কয়েকবার। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে জানুয়ারিতে ৭, ফেব্রুয়ারিতে ১, মার্চে ৫, জুনে ১, জুলাইয়ে ২, আগস্টে ৪, সেপ্টেম্বরে ৮, অক্টোবরে ৪, নভেম্বরে ১৪ ও ডিসেম্বরে ৫ দিন শ্রমিক আন্দোলন চলে। চলতি বছরেও ১৩ দিন শ্রমিক আন্দোলন ও অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। কারখানা এক দিন বন্ধ থাকলে কোটি টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়। বিজিএমইএ বলছে, ইতোমধ্যে ছোট-বড় ১ হাজার ৯৪০টি কারখানা শনিবার পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। তবে ১৬৭টি কারখানা এখনও পরিশোধ করতে পারেনি। উল্লেখ্য, বিজিএমইএ’র প্রচেষ্টায় কিছুদিন আগে টিফিন ও হাজিরা বোনাস, নাইট বিল বৃদ্ধির দাবিপূরণের কথা শোনা গেলেও, ঈদকে সামনে রেখে বকেয়া বেতন-বোনাসসহ নানা দাবি উঠছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করতে হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে প্রশাসন।
আসলে দেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্যতম একটি পোশাকশিল্প। স্বীকার করতেই হবে, রপ্তানিমুখী শিল্পের সবচেয়ে লাভজনক পোশাকশিল্প খাতের শ্রমিকের মজুরিই সবচেয়ে কম। সর্বশেষ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও কাজের নিশ্চয়তা প্রদানের বিধান রেখে জাতীয় শ্রমনীতি ২০১৩ প্রণীত হয়। তৎকালীন সরকার পোশাকশিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু মজুরি বাদে নীতিমালার আর কোন অংশ কার্যকর হয়নি। পরে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও নিরাপদ কারখানার জন্য শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠে। আমরা মনে করি, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ ন্যূনতম মজুরি চাওয়া অযৌক্তিক নয়। এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। মনে রাখা দরকার, শিল্পের উৎপাদনশক্তির মূল অনুষঙ্গ শ্রমিক। তাদের অসন্তুষ্ট রেখে উৎপাদনের চাকা গতিশীল করা সম্ভব নয়। পোশাকশিল্পের স্বার্থেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মানবিক জীবনের নিশ্চয়তা দরকার। শ্রমিকদের এই পরিস্থিতি বিদেশি ক্রেতাদেশগুলোকে বিমুখ করে তুলতে পারে। আর শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি না হলে এই খাতে স্থিতিশীলতা ফেরা কঠিন।
এ কথা সত্য, ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে দেশের শিল্প সেক্টরে ব্যাপক নাশকতা হয়েছে। সে সময় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরাও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। সেসব ক্ষতি কাটিয়ে পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। শ্রমিকদের এ ধরনের কর্মসূচি ঘুরে দাঁড়ানোর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা এ ক্ষেত্রে শ্রমিক ও শিল্পোদ্যোক্তাদের পোশাকশিল্পের স্বার্থ সুরক্ষায় আন্তরিক হওয়ার কথা বলব। মালিকপক্ষের কাছে আবেদন থাকবেÑ শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধের মাধ্যমে তাদের দাবি পূরণ করার জন্য। সংকট নিরসনে প্রয়োজনে সরকার, মালিক, শ্রমিক এ ত্রিপক্ষীয় সমঝোতাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমরা মনে করি, পোশাক খাতে চলমান সংকট নিরসনে শ্রমিকদের সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, দ্রুত কার্যকরে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।