পরিবেশ
দীপংকর বর
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১১:১৯ এএম
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এ ধরণি বাসযোগ্য রাখতে বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বায়ুর গুণগত মান রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপ প্রভাব রোধ, ভূমিক্ষয় ও মরুময়তা রোধ, কার্বন সংরক্ষণ এবং কার্বন নিঃসরণ রোধসহ প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণে বন অনাদিকাল থেকে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বনভিত্তিক জীবিকা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। কিন্তু বন উজাড় ও অপ্রতুল সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে অনেক দেশেই বনজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রভৃতির কারণে প্রতিনিয়তই বনভূমির পরিমাণ কমছে। বিকাশমান কৃষি ও আবাসনের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। শুধু তাই নয়, নদী, খাল, জলাভূমি, জলাশয় ইত্যাদি জবরদখল ও ভরাটের কারণে প্রতিবেশের যে বিপর্যয় ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। তাই প্রতিবেশ, বন ও বন্য প্রাণী রক্ষায় বন আইন, বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনসহ এ-সংক্রান্ত সব আইন ও বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ ও যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
বন সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০১২ সালে ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বনজ সম্পদের গুরুত্ব তুলে ধরতে এবং নীতিনির্ধারক, গবেষক ও সাধারণ মানুষকে বনায়নের গুরুত্ব সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট একটি প্রতিপাদ্য কেন্দ্র করে এ দিবস পালন করা হয়। এবারও বন অধিদপ্তরে আন্তর্জাতিক বন দিবস উদ্যাপন করা হবে।
২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বন দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বনবনানী সংরক্ষণ, খাদ্যের জন্য প্রয়োজন’। এ প্রতিপাদ্য বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। বন আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। বিশ্বের বহু জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় বন থেকে প্রাপ্ত ফলমূল, বাদাম, মধু, ভেষজ উদ্ভিদ, মাশরুম ও শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সুতরাং বন কেবল তাদের পুষ্টির উৎস নয়, বরং জীবনধারা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ছাড়া অনেক ঔষধি উদ্ভিদ পুষ্টি ও ভেষজ চিকিৎসার জন্যও ব্যবহৃত হয়। বন থেকে পাওয়া সব খাদ্য উপাদান মানুষকে পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি স্থানীয় জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতেও ভূমিকা রাখে। বন উজাড় হলে খাদ্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়ে। সঠিকভাবে বন সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫.৫৮ ভাগ এবং এবং বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ২২.৩৭ শতাংশ; যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। দেশের প্রধান বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন, মধুপুর গড় ও শালবন উল্লেখযোগ্য। বনভূমির ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, অনিয়ন্ত্রিত বন নিধন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বনসম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ কাঠ কাটার প্রবণতা, চারাগাছের অপর্যাপ্ত রোপণ, বনাঞ্চলের ওপর অনুপ্রবেশ এবং বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের যেটুকু বনাঞ্চল আছে তার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বনের স্বাস্থ্য ও বৈচিত্র্য উন্নত করতে হবে। বন অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পতিত ও প্রান্তিক সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি বনায়নের আওতায় এসেছে। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও সরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নির্মল পরিবেশ সৃষ্টিতে সামাজিক বনায়ন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের জন্য সবুজ অর্থনীতির যাত্রা ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বন সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বননির্ভরশীল জনগোষ্ঠী যেমন বিশেষ নৃগোষ্ঠী, কৃষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা বনসম্পদের প্রতিদিনের ব্যবহারকারী। তাই বন সংরক্ষণে তাদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার স্থানীয় জনগণকে বন রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করছে, যেখানে তারা বন সৃজনের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও পরিবেশবাদী সংগঠন স্থানীয় জনগণের মধ্যে বন সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দরকার। বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকার প্যানেল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা কাজে লাগিয়ে দেশি নীতিমালা প্রণয়ন করলে বন সংরক্ষণ আরও কার্যকর হবে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বনজ খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা উন্নয়নের পথ সুগম করা সম্ভব হবে। বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে জনসচেতনতা, কার্যকর নীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার, গবেষক, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তার সংকট ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মুখে বন সংরক্ষণ ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতির প্রয়োজনীয়তা আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই উন্নয়ন নীতিমালায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন, বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই কৃষিচর্চার মাধ্যমে এ ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে, তবে তা আরও কার্যকর করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।
এ দেশকে বর্তমান জনগোষ্ঠী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য, টেকসই পরিবেশ উন্নয়নকল্পে বিজ্ঞানভিত্তিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ, উন্নয়ন, বনজদ্রব্যের টেকসই উৎপাদন এবং এর সুচিন্তিত ও টেকসই ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, কৃষক, গবেষক এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। বন উজাড় বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা, বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং গবেষণা ও প্রযুক্তির সহায়তায় বনসম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক বন দিবস, ২০২৫ আমাদের এ বাস্তবতা উপলব্ধি করার সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে সবাই মিলে একটি সুস্থ, সবুজ ও খাদ্যনিরাপদ পৃথিবী গড়ার জন্য অবদান রাখতে পারে। এখন সময় এসেছে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করার, যাতে বন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।