× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্থানীয় সরকার

কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন জরুরি

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫ ১১:৪০ এএম

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

একাত্তরে রক্তস্নাত অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর একাধিকবার বড় আকারের আঘাত এসেছে। প্রতিবারই দেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে এনেছে। এমন ঘটনার আরেকবার সাক্ষী হতে পেরেছি ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাশীল ও অস্থিতিশীল বিশ্বে জনগণের মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং নিজ ইতিহাসের বিশুদ্ধতা রক্ষার সংগ্রাম পরিপূর্ণতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। জুলাই আমাদের আবু সাঈদ ও মুগ্ধর মতো বীরদের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা পরিহার করে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সুযোগ গড়ে দিয়েছে; সেটি যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন। কিন্তু আমরা যে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আলোচনা করছি তার জন্য প্রয়োজন সুশাসন। আর এ সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রশাসন পরিপূর্ণভাবে সংস্কারের বিকল্প নেই। এ সম্পাদকীয় স্তম্ভেই ইতোমধ্যে বহুবার এ বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করেছি এবং সম্ভাব্য কিছু পন্থাও উপস্থাপন করেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিষয়টি অনেকের মনঃপূত হলেও কার্যক্ষেত্রে দৃশ্যমান উদ্যোগ গড়ার মতো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই বিষয়টি নিয়ে সময় থাকতেই সবিস্তার আবার লেখার তাগিদ অনুভব করছি।

দেশে জনপ্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে। বিগত সরকারের পরিচালনায় জনপ্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রাতিষ্ঠানিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ফলে মানুষ প্রশাসনের কাছে যে ধরনের সুযোগসুবিধা প্রত্যাশা করেছিল তার কিছুই আদায় করতে পারেনি। আর জনপ্রশাসনে এ দুর্বলতায় অর্থনীতি থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক খাতেও ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হয়েছে। এজন্য অতীতে বহু কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং নতুন করে আধুনিকায়নের কথাও উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে ফলপ্রসূ হয়নি কিছুই। বরং আমরা দেখেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিতর্ক আরও বাড়িয়েছে। নীতিনির্ধারকরা বরাবরই দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা সুসংহত করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন না, এমন অভিযোগ বিভিন্ন মহলের। প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে দেশের মানুষকে নানা সুযোগসুবিধা ও কল্যাণকামী উদ্যোগগুলো সহজভাবে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানিক প্রয়োজন, চাহিদা ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ সাধন কঠিন কিছু নয়। বরং প্রশাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতি আস্থা ফেরানোর জন্য তা একটি বড় অংশীজন হয়ে উঠতে পারে।

দেশে জনপ্রশাসন ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পথ পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে জনপ্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। আমরা দেখছি, প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদপূরণ এমনকি সিভিল সার্ভিসের নিয়মানুবর্তিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। যদিও এসব কার্যক্রম সচরাচর রাষ্ট্রপতির মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় কিন্তু আমরা দেখেছি একটি রাজনৈতিক সরকারই এসব বিষয়ে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করে। উপরন্তু সিভিল সার্ভিস এখন অনেকের জন্য রাজনৈতিক আকর্ষণেরও কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমরা বরাবরই ভুলে যাই, সিভিল সার্ভিস জনগণের নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনিক যন্ত্রই নয়, বরং প্রজাতন্ত্রের কৌশলগত প্রতিষ্ঠানও বটে।

জনপ্রশাসনের রাজনীতিকরণ সাধারণ মানুষের সেবার মান নিম্নমুখী যেমন করেছে, তেমন স্বচ্ছতা ও সরকারের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটিও বিগত কয়েক দশকে নাজুক করে তুলেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা আর জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট ক্রমেই বাড়ছে। এমন এক সময়ে জনপ্রশাসনের কর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এ সংকটের দায় বিগত সরকারের একার ওপর চাপালে চলবে না। বরং স্বাধীনতার পরবর্তী সময় বিভিন্ন সরকারের অধীনে প্রশাসনে স্বজনপ্রীতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলেই বর্তমানে এমন জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে।

প্রশাসন জনবান্ধব করার জন্য একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড সার্ভিসের রিঅর্গানাইজেশন কমিটি (এএসআরসি) গঠন করা হয়। এ কমিটি প্রথমে কিছু সংস্কার উপস্থাপন করে। এ কমিটি ১৯৭২ সালের অক্টোবর এবং ১৯৭৩ সালের মার্চ এ দুই ধাপে সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। তারা একটি ‘সমন্বিত গ্রেডিং ব্যবস্থা’ এবং ‘শ্রেণিহীন সিভিল সার্ভিস’-এর প্রস্তাব দেয়। একটি স্বাধীন দেশে স্বচ্ছ আমলাতন্ত্র তৈরির জন্য একটি আদর্শ প্রস্তাব ছিল সেটি। দুঃখের বিষয়, যুগান্তকারী এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হয়নি। মেধাবী এ সমাজবিজ্ঞানীর উদ্যোগ আশার আলো দেখেনি। বরং পাকিস্তান শাসনামলে থাকা সিএসপি ব্যবস্থাই টিকে রইল। আর প্রস্তাব শেলফের এক কোণে একটি কমিটির আবিষ্কার হয়েই থাকল।

পরবর্তী সময়ে পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭৬ সালে। এ সময় প্রশাসন ক্যাডারকে ক্ষমতায়িত করা হয়। সিএসপি ও পিএসপি গ্রুপ ওই সময় সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে আরও জাঁকিয়ে বসে। ১৯৮২ সালে অর্থাৎ এরশাদের সময় এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। প্রশাসনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলে উপজেলা পরিষদ গঠনের পথ উন্মুক্ত হয়। স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়িত করার জন্য এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সালে ব্রিগেডিয়ার এনাম প্রশাসনিক কাঠামোর নবায়নে জোর দেন। পরবর্তী বছরগুলোয় স্থানীয় প্রশাসন জাতিসংঘসহ অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা পেতে শুরু করে। এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ১৯৯১ সালে প্রশাসনকে আবার নতুন কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিঅর্গানাইজেশন কমিটি (এআরসি) গঠন করা হয় সাবেক সচিব নুরুন নবীর নেতৃত্বে। তার পদক্ষেপও ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশন (পিএআরসি) গড়ে ওঠে ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে। কিন্তু ওই কমিশনের প্রস্তাব পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি।

২০০৭-০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনকল্যাণের জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়। তারা অবশ্য প্রশাসনকে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির একটি পন্থা হিসেবে ব্যবহার করে। এজন্য কিছু কমিশন গঠিত হয় যা পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিলুপ্ত করা হয়। এভাবেই আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক প্রভাবে ধুঁকতে শুরু করে। প্রশাসন নির্বাচনের সময় রাজনীতিকদেরই বেশি সুবিধা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নাগরিক সেবা দেওয়ার পথ সুগম করার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।

আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের দর্শন ও কাঠামো কোনোটিরই আজ অস্তিত্ব নেই। ফলে ‘দায়বদ্ধতা’ একটি শব্দমাত্র। যখনই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করে তখন স্থানীয় সরকার পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে। যেহেতু স্থানীয় সরকার স্বশাসিত নয়, তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। সম্প্রতি পটপরিবর্তনের পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)-এর স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও কেন্দ্রীয়ভাবে স্থানীয় সরকারকে আটকে রাখার ব্যবস্থা মাত্র। বাস্তবে স্থানীয় সরকার তার নিজস্ব অঞ্চলের মানুষের চাহিদা এবং বাস্তবতা অনুসারে কাজ করবে। আমরা এখন এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি যখন স্থানীয় প্রতিনিধিরা এগিয়ে এলে দেশের গণতন্ত্র তৃণমূল পর্যায় থেকে সুসংহত হতে শুরু করবে। এজন্য স্থানীয় সরকারকে স্বশাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। এখনই যদি তা না করা যায় তাহলে সামনে তা বাস্তবায়নের আশা দুরাশা ছাড়া কিছু নয়। স্থানীয় সরকারের জন্য বরাদ্দ সচরাচর বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ বা বৈশ্বিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো দিয়ে থাকে। এ সময় তারা যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং স্থানিক চাহিদা ও উন্নয়নের পরিকল্পনার নিরিখে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি স্থানীয় সরকারকে তাদের কর আদায়ের আলাদা ব্যবস্থা দিতে হবে। তারা যেন নিজেই ক্ষমতায়িত হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একদম শুরু থেকেই করতে হবে এমন নয়। অনেক সময় আমাদের কাছে যা আছে তার কিছুটা সংস্কার করেও অনেক উন্নত কাঠামো নির্মাণ সম্ভব।

স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়িত করার জন্য প্রশাসনের উদার সহযোগিতা জরুরি। এজন্য স্থানীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট কার্যালয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসবেন স্থানীয় সরকারের নির্বাহী প্রধান। দেশে জনপ্রশাসন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঠ পর্যায়ে যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে সরকার লাভবান হবে। আবার শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গবেষণায় উৎসাহিত হবে। স্থানীয় সরকার কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনার জন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। যেহেতু এখন সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে তাই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থেই আমাদের স্থানীয় সরকারকে পুনর্গঠনের দিকে নিয়ে যেতে হবে।

  • স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা