ক্যানসার
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫ ১১:৩৭ এএম
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন
বর্তমানে ক্যানসার একটি প্রাণঘাতী রোগে পরিণত হয়েছে। দেশে যত ধরনের ক্যানসার রয়েছে তার মধ্যে কলোরেক্টাল ক্যানসার অন্যতম। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ক্যানসারে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করলে কলোরেক্টাল ক্যানসারে মৃত্যুর হার দ্বিতীয় অবস্থানে। তাই এ ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। আমাদের পরিপাকতন্ত্রের নিম্নাংশ মূলত বৃহদন্ত্র (কোলন) এবং মলাশয় (রেক্টাম) দ্বারা গঠিত। এই কোলন ও রেক্টামের একটা প্রাণঘাতী রোগ হলো এই অংশের ক্যানসার; যাকে আমরা সংক্ষেপে বলি কলোরেক্টাল ক্যানসার। এ রোগে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে ৪৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সিদের এ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি। আবার পরিবারের নিকটাত্মীয়ের কারও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কাও কম নয়। অর্থাৎ জিনগত কারণেও এ রোগ হতে পারে। পাশাপাশি যাদের রেক্টাল পলিপ রয়েছে, কোলনে আলসার জাতীয় রোগ রয়েছে, তাদের জন্যও এ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো, কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগতে হয়। যত ক্যানসার রয়েছে তার মধ্যে এ ক্যানসারটিতে যন্ত্রণা হয় অনেক।
জানা প্রয়োজন, এ ক্যানসার কীভাবে সৃষ্টি হয়। প্রথমত, অতিরিক্ত ধূমপান যারা করেন বা খাদ্যাভ্যাসে যাদের কিছু সমস্যা রয়েছে, তারা কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। শুরুতে ছোট আকারের পলিপ বা মাংসপিণ্ড তৈরি হয় কোলন বা বৃহদন্ত্র ও রেকটাম বা মলাশয়ের দ্বারে। এটা ধীরে ধীরে বড় হয় এবং একপর্যায়ে ক্যানসারে রূপ নেয়। এ সময় মলত্যাগের সময় মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া কিংবা মলত্যাগের অভ্যাসে আচমকা পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। দিনে পাঁচ-ছয়বারের বেশি মলত্যাগ করে অনেকে। তা ছাড়া ঘন ঘন ডায়রিয়া আর অতিরিক্ত কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো ঝামেলাও বাড়তে শুরু করে। পেটের ডান পাশে নিচের দিকে কোনো চাকা বা পিণ্ড অনুভব করা। রক্তশূন্যতা দেখা দেওয়া, যার কারণে শরীরে অতিরিক্ত দুর্বলতা অনুভব করা কিংবা অল্প শারীরিক পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা। যদি সমস্যাসমূহ দুই সপ্তাহের মতো সময় স্থায়ী হয়, তাহলে দেরি না করে উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়াও কিছু জরুরি উপসর্গ রয়েছে। শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্তরা হাসপাতালে ভর্তি হন অন্ত্র ফুলে গিয়ে পেট ফুলে যাওয়া বা ইনটেসটিনাল অবস্ট্রাকশন আকারে। কখনও এই টিউমার ফেটে গিয়ে রক্তপাত জটিল পরিস্থিতিতে রূপ নিতে পারে। আবার কখনও, কখনও ক্যানসার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার (যেমন : লিভার, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, হাড়) উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসতে পারেন।
কিছু খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণও এ ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। যেমনÑ কম চর্বিযুক্ত ও অধিক আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া। খাদ্যতালিকায় প্রচুর সবজি আর ফলমূল রাখা। নিয়মিত ব্যায়াম আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। লাল মাংস এড়িয়ে যাওয়া জরুরি
যখনই সন্দেহ হবে, তখন কীভাবে এই রোগে আপনি আক্রান্ত বুঝবেন? দেশে সচরাচর অনেকে ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে যেমন অবহিত নন, তেমনি কীভাবে এই রোগে আক্রান্ত কি না শনাক্ত করার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে। যদি আপনি নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের আওতায় থাকেন, তাহলে খুব সহজে এই রোগ নির্ণয় করা যায় এবং প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারলে এর সফলতার হার অনেক বেশি। সাধারণত নিম্নোক্ত কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের স্ক্রিনিং করা হয়। এফওবিটি টেস্ট করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর মল মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা হয় রক্তের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এটি একটি অতি সহজ এবং দ্রুত পরীক্ষা যার মাধ্যমে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। চিকিৎসক কর্তৃক শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে মলদ্বার ও মলাশয়ের নিচের অংশের টিউমার বা ক্যানসার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। আরেকটি পদ্ধতি হলো সিটি কলোনোস্কোপি বা সিটিস্ক্যান। সিটিস্ক্যান করে কোলনের অবস্থা দেখা হয় এবং সন্দেহযুক্ত কিছু থাকলে পরবর্তী সময়ে কোলোনোস্কপি পরীক্ষা করা হয়। আরও দুটো জনপ্রিয় পদ্ধতি রয়েছে যার একটি সরুটিউব বা নল যার অগ্রভাগে ক্যামেরা থাকে।
নিচের অংশ অর্থাৎ সিগময়েড কোলন যখন পরীক্ষা করা হয়, তখন এটাকে সিগময়ডোস্কপি বলা হয়, যখন সম্পূর্ণ কোলন পরীক্ষা করা হয়, তখন এটাকে কোলনোস্কপি বলা হয়। সন্দেহযুক্ত স্থান থেকে খুবই সামান্য পরিমাণ অংশ বায়োপসি আকারে নেওয়া হয় এবং পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
এ ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম (এমডিটি) বা টিউমার বোর্ড গঠন করা হয়। সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা থাকেন। উক্ত বিশেষজ্ঞ টিম ক্যানসারের ধরন এবং বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করেন।
ক্যানসারের বিস্তৃতি (স্টেজিং) যাই হোক না কেন এ ধরনের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য অধিকাংশ সময়ই সার্জারির প্রয়োজন হয়। স্থানীয়ভাবে শুধু টিউমার অপারেশন: পেট কাটার কোনো প্রয়োজন হয় না। শুধু মলদ্বার দিয়েই টিউমারটুকু কেটে নিয়ে আসা হয়। তবে শুধু প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় হলেই এই পদ্ধতিতে অপারেশন সম্ভব। হতে পারে পেট কেটে প্রচলিত পদ্ধতিতে অপারেশন। ল্যাপারোস্কপি পদ্ধতিতে পেটে শুধু ছিদ্র করে অপারেশন। আধুনিক বিশ্বে রোবোটিক সার্জারি অনেক জনপ্রিয় হচ্ছে। তবে খুব সহসাই হবে বলে প্রত্যাশা করে যায়।
ক্যানসার আক্রান্তদের সার্জারির পাশাপাশি আরও দুটি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। যেমন কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর শরীরে বিশেষ ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যাতে এর বিস্তৃতি ঠেকানো যায় অথবা পুনঃআবির্ভাব ঠেকানো সম্ভব হয়। অথবা যেক্ষেত্রে ক্যানসার শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে অর্থাৎ মেটাস্ট্যাসিস করা আরও সহজ হয়। দ্বিতীয়টি হলো রেডিওথেরাপি। এই পদ্ধতিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক্সরে বা বিকিরণ রশ্মির মাধ্যমে ক্যানসার আক্রান্ত স্থানে থেকে যাওয়া ক্যানসারের কোষসমূহকে নির্মূল করা হয়। অনেক সময় বড় টিউমার বা ক্যানসারের আকৃতি রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে ছোট করে নিয়ে আসা হয়, যাতে করে সহজেই অপারেশন বা সার্জারি করা যায়।
উত্তরটা হ্যাঁ, যদি পলিপ থেকে ক্যানসার হয়। রোগটা যখন পলিপ আকারে থাকে (ছোট মাশরুমের ন্যায় মাংসপিণ্ড) তখন কিন্তু এতে ক্যানসার তৈরি হয়নি। এই অবস্থায় যদি পলিপটি শরীর থেকে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে অবশ্যই এই ক্যানসার থেকে নিজেকে প্রতিরোধ করা যাবে। যাদের পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাদেরকে নির্দিষ্ট বিরতিতে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আসতে হবে।
কিছু খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণও এ ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। যেমনÑ কম চর্বিযুক্ত ও অধিক আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া। খাদ্যতালিকায় প্রচুর সবজি আর ফলমূল রাখা। নিয়মিত ব্যায়াম আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। লাল মাংস এড়িয়ে যাওয়া জরুরি। ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধের ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য নিজের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই বেশি জরুরি।