প্রজন্মের ভাবনা
মোহাম্মদ জাহিদ হাসান
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫ ১১:৩২ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
জানালার বাইরে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, পাশে গরুর গাড়ি চলছে ধীরগতিতে, আর ছোট একটি স্কুলের মাঠে কিছু শিশুর কোলাহলÑ এ দৃশ্য বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের চিরচেনা রূপ। কিন্তু ঠিক এ চিত্রের মধ্যেই যদি দেখা যায় একটি টিনের ছাউনির নিচে একদল শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করছে, কিংবা একজন কৃষক মোবাইলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নিজের ফসলরক্ষার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? এমন বাস্তবতা হয়তো কল্পনাতীত মনে হতে পারে, কিন্তু স্পেসএক্সের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা বাংলাদেশে চালু হলে এ স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, স্টারলিংক কি বাংলাদেশকে সত্যিকারের ডিজিটাল অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে পারবে, নাকি এটি কেবল উচ্চমূল্যের এক প্রযুক্তিগত পরীক্ষা, যা শেষ পর্যন্ত শ্রেণিবিশেষের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
স্টারলিংক মূলত লো-আর্থ অরবিট (এলইও) স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। প্রচলিত ব্রডব্যান্ড পরিষেবাগুলো যেখানে তার ও মোবাইল টাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল, স্টারলিংক সেখানে মাটির সংযোগ ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে সক্ষম। ফলে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা কিংবা বন্যাকবলিত স্থানে যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কার্যত অচল, সেখানেও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে স্টারলিংকের সুবিধা পাচ্ছে।
কিন্তু আমাদের দেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এ প্রযুক্তি কতটা বাস্তবসম্মত? বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গড় মাসিক খরচ ১০০০-২৫০০ টাকা, যেখানে মোবাইল ইন্টারনেট আরও সাশ্রয়ী। অথচ স্টারলিংকের মাসিক চার্জ প্রায় ১২,০০০ টাকা, আর সংযোগের ডিভাইসের মূল্য প্রায় ৬০,০০০ টাকা; যা গ্রামীণ কিংবা নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য এটি কার্যত বিলাসিতা। প্রশ্ন ওঠেÑ সরকার কি কোনো ধরনের ভর্তুকি বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর মাধ্যমে এ খরচ কমাতে পারে? যদি সাশ্রয়ী মূল্যে স্টারলিংক সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে টেলিমেডিসিন সেবা, কৃষকের জন্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস, কিংবা দূরশিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ডিজিটাল খাত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু এখনও অনেক জায়গায় ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সংযোগজনিত সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অস্থির ইন্টারনেট সংযোগ অন্যতম বাধা। স্টারলিংকের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন, উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করা গেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। এসব দুর্যোগের সময় মোবাইল টাওয়ারগুলো বিকল হয়ে যায়, ফলে যোগাযোগব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। স্টারলিংক এমন একটি বিকল্প, যা নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে, বিশেষ করে দুর্যোগকালীন উদ্ধার অভিযানের সময় এটি জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে স্টারলিংককে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জরুরি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর প্রশিক্ষণ, ব্যাকআপ পাওয়ার সাপ্লাই এবং একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় সংযোগ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এ প্রযুক্তির সম্ভাবনা কেবল তাত্ত্বিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকবে।
দেশের কিছু স্পর্শকাতর যেমন চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস, সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকাগুলোয় স্টারলিংকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা অপরাধীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে। আবার উল্টো দিক থেকে, সরকার যদি এটি রাষ্ট্রীয় নজরদারির অংশ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তবে ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।