সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫ ১১:৫৪ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
শিশুটি মৃত্যুর ভেতর হারিয়ে গেলো। শত চেষ্টাতেও বাঁচানো গেলো না। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সাধারণ ধারণার আগেই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। অথচ তারও বাবা-মা ভেবেছিল শিশুটি হাসবে-খেলবে অন্য শিশুদের হাত ধরে আগামীর সুন্দর দিনের স্বপ্ন দেখবে। স্বপ্নের কুঁড়েঘরে স্বপ্ন বোনা ইচ্ছেরা পাখা মেলার আগেই অনন্তে হারিয়ে গেলো শিশুটি। তার শোকে দুঃখিনী মা আজ ভীষণ কাঁদছে। কাঁদছে মানুষ, প্রতিটি বুকে স্থির, পাথর হয়ে গেছে আমাদের সন্তান। যে বর্বরতা, যে নৃশংসতার বলি হতে হয়েছে মাগুরার ৮ বছরের শিশুটিকে, তাতে আমরা ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, মর্মাহত। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টাও তাকে ধরে রাখতে পারেনি। মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে গেছে তাকে। তার এই না ফেরার বেদনা আমাদের স্তব্ধ করে, আমাদের অপরাধী করে দেয়। পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা জানা-বোঝার আগেই তার এই অনন্তযাত্রায় আমরা শোকে মুহ্যমান, বাকরুদ্ধ। ‘বাঁচানো গেল না শিশুটিকে’ শিরোনামে ১৪ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখেয়েছে, নারী ও শিশুর নিরাপত্তা এবং সুরক্ষায় আমাদের ব্যর্থতা। আমরা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
৬ মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়ি মাগুরায় বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। প্রথমে অচেতন অবস্থায় মাগুরা হাসপাতালে, পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে এবং সেখান থেকে রাতেই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ৭ মার্চ রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তারপর সিএমএইচে। সেখানেই তার চিকিৎসা চলছিল।
এ কথা সত্য, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিথিলতার সুযোগে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গে নারী-শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছিল। ধর্ষণ এখন আর সমাজের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এটি একটি ক্রমবর্ধমান ব্যাধি। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো শিশু, নারী যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অতিসম্প্রতি গণপরিবহনসহ নানা স্থানে নারী হেনস্থা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে।
বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড বিধান রয়েছে। ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণের ঘটনা বাড়তে থাকায় সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন এনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। তখন কঠোর শাস্তির কারণে কিছুটা ভীতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাতে কি ধর্ষণ কমেছে? কিংবা আইন থাকলেও কোথাও কি যথাযথ আইন প্রয়োগ হয়েছে? এখনও বিচার চাইতে এসে নারী নানা রকম হয়রানির শিকার হন। বাড়ছে নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা। আমরা মনে করি, এখানে সর্বোচ্চ শাস্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করায়। গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বিচারপ্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণের ওপর। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিচার চাইতে এসে পদে পদে হয়রানি বন্ধ করা। এ ক্ষেত্রে বিচারক এবং আইনজীবী উভয়েরই দায় রয়েছে। আইনবিদরা বলছেন, শাস্তির চেয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বেশি দরকার। নারীবাদী সংগঠনগুলো বলছে, শুধু কঠোর শাস্তি দিলেই হবে না, পুলিশের প্রশিক্ষণ ও ভুক্তভোগীদের সহায়তাব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে। এ বিষয়ে কঠোর আইন ও দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণের শাস্তি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। শুধু তাই নয়, পরিবার থেকে স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সর্বত্র সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আমরা মনে করি, সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। সময় এসেছে সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিচারব্যবস্থার সংস্কার।
আমরা দ্রুততম সময়ে শিশুটিকে হত্যা ও ধর্ষণের বিচার দাবি করি। আমরা চাই, শিশুটির ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হোক। এই বর্বরতার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে এমন নির্মম মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। দেশে ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতির মতো অপরাধ প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আইনের শাসন ও বিচারহীনতার অভাবে বাড়ুক, তা কাম্য হতে পারে না। একে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।