শ্রদ্ধাঞ্জলি
হারুন হাবীব
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫ ১১:৪৮ এএম
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও, হামেশা দেখাসাক্ষাৎ না ঘটলেও তার সঙ্গে আমার একটা যোগসূত্র ছিল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সাংবাদিকতা বিভাগে পড়েছি, আরেফিন আমার পরের ব্যাচের, কোন ব্যাচ ঠিক মনে পড়ে না। সে অর্থে আমি তার সিনিয়র, কথাটি তিনি মনে রেখেছিলেন। ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়তে আসেন। আমি সেদিনের ক্ষুদ্রায়তন বিপিআই নিউজ এজেন্সির জুনিয়র প্রতিবেদক থেকে। সেই থেকে এক ধরনের সম্পর্ক আমাদের, যা আমরা কেউ ভুলিনি।
এরপর এমএ শেষ করে আমি সদ্যস্বাধীন দেশের সাংবাদিকতা পেশায় সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত হই। একসময় জাতীয় সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এ যোগ দিই, আরেফিন পরের দিকে প্রথম বিভাগে প্রথম হন। তারপর ১৯৮০ সালের দিকে (সম্ভবত) বিভাগের শিক্ষক হন। তখন থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই। শুনেছি এরই মধ্যে স্কলারশিপ নিয়ে ভারতের মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন, এশিয়া ও আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত থেকেছেন।
যেহেতু সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে সবটা জীবন কেটেছে, সেহেতু নতুন প্রজন্মের বহুসংখ্যক সংবাদকর্মীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে, এ তরুণরা বেশিরভাগই আরেফিনের সরাসরি ছাত্রছাত্রী। অবাক হয়ে লক্ষ করেছি এরা বেশিরভাগই তাদের ‘স্যার’-এর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং নানা বিষয়ে পরামর্শ নেন। একজন শিক্ষক হিসেবে এটি আরেফিনের বিরল কৃতিত্ব ও অর্জন বইকি। আরও লক্ষ করার মতো যে, এসব ছাত্রছাত্রী অবলীলায় তাদের স্যারের নামের আগে ‘আআমস’ শব্দগুলো উচ্চারণ করতেন; যা অনেক সময়ই আমার মনে রাখা সম্ভব হতো না! কারণ আরেফিনের পুরো নাম ছিল আবু আহসান মোহম্মদ সামসুল (আআমস) আরেফিন সিদ্দিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৬২। পাকিস্তান আমলে। সেদিনকার খ্যাতিমান সাংবাদিক ও তুখোড় সংবাদ ধারাভাষ্যকার আতিকুজ্জামান খানের প্রবল প্রচেষ্টায় বিভাগটির গোড়াপত্তন ঘটে। কয়েক বছরের ব্যবধানে যোগ দেন অধ্যাপক একিউআইএম নূরউদ্দীনসহ কয়েকজন খ্যাতিমান অধ্যাপক যারা সবাই মিলে বিভাগটির বিস্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। আমার সুযোগ হয়েছিল এসব শিক্ষাবিদের সরাসরি ছাত্র হওয়ার।
নবগঠিত সাংবাদিকতা বিভাগে প্রথম দিকে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট ও দুই বছরের এমএ ডিগ্রি দেওয়া হতো। পরে অনার্স কোর্স এবং এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ হওয়ার পর বিভাগটি দ্রুত উন্নতি সাধন করে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আরেফিন সিদ্দিক চার দশক এ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন তিনি Ñ দুই পর্বে Ñ সম্ভবত ২০০৯ সাল থেকে। এরপর আবারও ফিরে গেছেন শিক্ষকতায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান বাংলাদেশের মূলধারার সাংবাদিকতায়Ñ প্রিন্ট ও টেলিভিশন Ñ যারা বড় ভূমিকা রেখে চলেছেন তাদের বেশিরভাগই এ বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী।
১৯৯৯-২০০০ সালে জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসসের দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে, তখন সংস্থাটির পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর একিউআইএম নূরউদ্দীন। আমার বিশেষ অনুরোধে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হয়েছিলেন কীর্তিমান সম্পাদক যথাক্রমে গোলাম সারওয়ার, বজলুর রহমানসহ সাংবাদিকতার আরও অনেক প্রথিতযশা মানুষ। এর আগে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিক, পরের দিকে আবারও তিনি একই দায়িত্ব পালন করেছেন।
আগেই লিখেছি, আমার সঙ্গে আরেফিনের যোগাযোগ ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু আমি নানা অঙ্গনে তার কর্মসাফল্য বা পদচারণ সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। কদাচিৎ দেখা হতো বিবিধ অনুষ্ঠানে, আমরা কুশল বিনিময় করতাম। তার জীবনদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরেফিন সিদ্দিক পথ চলেছেন, দৃঢ় পায়ে। হতে পারে সে পথের পক্ষ-বিপক্ষ ছিল; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষীণদেহী, মৃদুভাষী মানুষটি নিজ বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন বরাবর।
তার মৃত্যুটিও অবাক করার মতো! ৬ মার্চ, ২০২৫। দিনের কাজ শেষে ইফতার কিনতে গেছেন ঢাকা ক্লাবে বিকালের দিকে। যতটা শুনেছি, কথা বলতে বলতেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান সেখানে, মাথায় শক্ত আঘাত পান। দ্রুত ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি! আমি তার আত্মার পারলৌকিক শান্তি কামনা করি। তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।