ড. মইনুল হাসান
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫ ১১:৩৫ এএম
ড. মইনুল হাসান
তারিখ : শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। স্থান : হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিস, ওয়াশিংটন। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়েছেন দুই নেতা। একজন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বয়স : ৭৮ বছর এবং অন্যজন স্বাধীনতা এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে যুদ্ধরত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, বয়স : ৪৭ বছর। সংবাদমাধ্যমের বেশ কিছু ক্যামেরা তাক করে আছে দুই নেতার মুখের দিকে। বৈঠকের শুরুতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট অনেকটা আত্মগর্বী। কারণ তিনি ভালোভাবেই জানেন তাবৎ বিশ্ব তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রান্ত হওয়ার জন্য তিনি যেভাবে আঙুল উঁচিয়ে জেলেনস্কিকে অভিযুক্তি করছিলেন, তা অনেকটাই ছিল ভ্লাদিমির পুতিনের মতো। কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, সে বৈঠকে পুতিনের দুরাত্মা ট্রাম্পের ওপর ভর করেছিল। তারিখ : সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮। স্থান : ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি। ট্রাম্প প্রথমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেই প্রথমবার পুতিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। প্রাক্তন কেজিবি কর্মকর্তা পুতিনকে তার অচেনা নয়। পুতিনও ট্রাম্পের অনেক গোপন খবর রাখেন। সে বৈঠকে শুধু ট্রাম্প, পুতিন এবং তাদের দুজন দোভাষী উপস্থিত ছিলেন। অন্য কাউকে সেখানে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। এমন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে, ট্রাম্পকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। সাংবাদিকদের তীর্যক প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেছিলেন, ‘এর আগে একজন আধিপত্যবাদী একনায়কের সামনে কখনোই কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন বিশ্রীভাবে নতজানু হননি।’
কী কারণে বা কী এমন ঘটেছিল যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন উদ্ধত চরিত্রের মানুষ পুতিনের সামনে নুয়ে পড়েছিলেন, ভেজা বিড়াল সেজেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সত্তর দশকের বছরগুলোতে। সে সময়ে বছর ত্রিশেক বয়সের তরুণ ডোনাল্ড তার পিতার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় ভাগ্য গড়ার কাজে দিনরাতের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন নিউইয়র্কের কোনি আইল্যান্ডের কাছে, ব্রাইটন বিচ এলাকায়। অবসরে বন্ধুদের নিয়ে রাতের নাচঘরে হইহুল্লোড়ে মত্ত হতেন। এ এলাকায় তখন রুশ নাগরিক, ব্যবসায়ীদের বেশ আনাগোনা ছিল। ঠান্ডাযুদ্ধের সে সময়ে তাদের মধ্যে বেশ কিছু ছিল সোভিয়েত গুপ্তচর। সুসংগঠিত রুশ মাফিয়া চক্রের ঘাঁটিও ছিল এ এলাকায়। উঠতি বয়সের উঠতি ব্যবসায়ী ডোনাল্ডের সঙ্গে তাদের সখ্য হয়। এদের মধ্যে মাফিয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত সেমিয়ন কিসলিন এবং টেমুর সেপিয়াশভিলি ছিলেন বিশেষ উল্লেখ্য। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবসার আড়ালে অন্ধকার জগতে বিচরণ ছিল তাদের। ট্রাম্প নিউইয়র্কে কমোডর হোটেল কিনে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত করার কাজ দেন এ দুই ব্যক্তিকে। পরে এ হোটেলের নাম দেন ‘হায়াত গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল’। সে সময় কিসলিন এবং সেপিয়াশভিলির পাল্লায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট রিয়েল এস্টেটের বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি নিষিদ্ধ পথে পা বাড়ান। জালিয়াতি, বীমা কেলেঙ্কারি এবং কালোবাজারে জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রচুর অর্থ, বিত্ত ও সম্পদ করায়ত্ত করতে সক্ষম হন। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেশ কয়েকবার আইনি ঝামেলায় পড়তে হয়। ২০১৬ সালে অবমুক্তকৃত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায় মস্কোর গুপ্তচরেরা এ নববিবাহিত দম্পতিকে বিশেষ নজরদারিতে রেখেছিলেন। এজন্য সে সময়ে ‘আল জারজা’ এবং ‘লুবোস’ ছদ্মনামে দুজন গুপ্তচরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন পর্যন্ত রাজনীতির প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মোহ বা আগ্রহ জন্মেনি। তিনি ব্যবসা জগতের মেগাস্টার হওয়ার লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দৈনিক নিউইয়র্ক পোস্টের ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় তার সাফল্যের চমকপ্রদ কীর্তিকাহিনী বহুবার প্রকাশিত হয়েছে।
সোভিয়েত সরকারের উঁচু মহলের আমন্ত্রণে ১৯৮৭ সালের জুলাইয়ে ৪১ বছর বয়সে ডোনাল্ড ট্রাম্প সস্ত্রীক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ৪ জুলাই মস্কো পৌঁছালে সেখানে তাদের রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং ক্রেমলিনের কাছে ন্যাশনাল হোটেলের বিলাসবহুল ‘লেনিন’ স্যুটটিতে থাকতে দেওয়া হয়। কথিত আছে, ১৯১৭ সালের অক্টোবরে স্বয়ং ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন এ স্যুটটিতে ছিলেন। সোভিয়েত গুপ্তচররা আগে থেকেই এ কক্ষের সর্বত্র প্রচুর গুপ্ত ক্যামেরা স্থাপন করে রেখেছিলেন। সেসব ক্যামেরায় কী ধরনের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল, আজও তা জানা যায়নি। তবে ডোনাল্ড নিউইয়র্কে ফিরে এসে নিজের গাঁট থেকে ৯৪ হাজার ৮০১ ডলার খরচ করে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বোস্টন গ্লোব এ তিনটি পত্রিকায় পুরো পাতাজুড়ে ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে বিজ্ঞাপন দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
২০১৩ সালে মিস ইউনিভার্স নির্বাচন উপলক্ষে ট্রাম্প আবারও মস্কো পা রাখেন। সেখানে তিনি রিটজ কার্লটন হোটেলে অবস্থান করেন। বলা হয়, এ হোটেলে অবস্থানকালে বাছাই করা সুন্দরী বারবনিতাদের দিয়ে রাশিয়ান নিরাপত্তা পরিষেবা, এফএসবি তাকে মধুর ফাঁদে ফেলে। তরুণী বারবনিতাদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য গোপনে ধারণ করা হয় বলে সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পায়। একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ গোয়েন্দা এ বিষয়ে ৩৫ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনও লেখেন। ‘মধুর ফাঁদে’ ট্রাম্পের পা দেওয়ার বিষয়ে কারও হাতেই মোক্ষম কোনো প্রমাণ না থাকলেও অনেকেই মনে করেন, হোয়াইট হাউসের মতো ট্রাম্পের চরিত্র অতটা সাদা নয়।
এফএসবিপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে পুতিন ‘মধুফাঁদ’ অস্ত্রটি ব্যবহার করেছিলেন মস্কোর দাপুটে প্রসিকিউটর ইউরি স্কুরাটভের বিরুদ্ধে। ইউরি স্কুরাটভ রাশিয়ার মাফিয়া, অলিগার্কদের শেকড় ধরে টান দিয়েছিলেন। পুতিন তখন রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন। তার নির্দেশে স্কুরাটভের হোটেল কক্ষে গোপনে ক্যামেরা স্থাপন করে দুজন নারীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করা হয়। শুধু তাই নয়, দেশের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। স্কুরাটভের চরিত্র হনন করে, তাকে তার দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
প্রতিপক্ষ, বিরুদ্ধমতের চরিত্রহননে ‘সেক্স ট্রাপ’ বা ‘মধুফাঁদ’ নামক অস্ত্রটি পুতিনের খুব পছন্দ। তার বিরুদ্ধে এ অস্ত্র অহরহ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। দেশে বা বিদেশে তিনি যাদের শত্রু বা প্রতিপক্ষ ভেবেছেন, তাদেরই বধ করেছেন, ধ্বংস করে দিয়েছেন পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন। আবার ভবিষ্যতে কাজে লাগানোর কুটিল মতলবে বেশ কিছু প্রমাণ নিজের হাতে রেখেছেন। নৈতিকতাবর্জিত পুতিন গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি হুমকি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের পরীক্ষিত বন্ধুদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পুতিনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। তবে তার মনে রাখা উচিত হবে, পুতিনের মধুতে বিষ আছে।