× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গাজা সংকট

ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা ব্যর্থ হচ্ছে

ডেভিড হার্স্ট, এডিটর ইন চিফ, মিডল ইস্ট আই

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৫ ১২:৪৫ পিএম

ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা ব্যর্থ হচ্ছে

গাজার ওপর বিবিসি একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে, যার নাম ‘হাউ টু সারভাইভ আ ওয়ারজোন’। প্রায় দেড় বছর ধরে পরিচালিত এ যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা কীভাবে বেঁচে রয়েছে তা কিন্তু এ ফিল্মটি একবারের জন্যও উপস্থাপন করতে পারেনি। আমরা দেখি একটি সিনে এক নারী খালি বোতল হাতে ছুটে পালাচ্ছেন। কারণ ইসরায়েলি সেনারা তাদের বাসস্থান ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। সেই নারী কারও দিকে না তাকিয়েই বলছেন, ‘খোদার গজব পড়ুক তোমার ওপর সিনওয়ার।’ এমনকি একটি ছেলে অনেকটা নিরাবেগ সুরেই ক্যামেরার সামনে বলছে, ‘আমাদের সামনে অনেক মানুষ মরতে দেখেছি। অনেকের পেট থেকে ভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছিল। আমরা কি নিরাপদ আছি?’ ১১ বছর বয়স্ক জাকারিয়া আল আকসা হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স পরিষ্কার করে সামান্য কিছু আয় করে। সে জানায়, ‘আমার ভলান্টিয়ার হতে ভালো লাগে। আমি অ্যাম্বুলেন্স ইউনিটের ভলান্টিয়ার হতে চাই।’ গোটা ডকুমেন্টারিতে এমন কিছুই নেই, যা ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক আচরণের বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে। বরং এ ধরনের ডকুমেন্টারি ইসরায়েলকে বিপাকে ফেলার মতো পরিস্থিতির সম্ভাবনা মুছে ফেলে। 

এমন এক ডকুমেন্টারি এটি, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ অত্যাচারের কোনো দৃশ্যায়নকেও ঘুচে ফেলা হয়। তারা যে নিপীড়িত বলে সহানুভূতি আদায় করা এক রাষ্ট্রের দ্বারা নির্যাতিত সে কথাটি আর সামনে আসে না। ইসরায়েল বরাবরই নিজেদের নির্যাতিত হিসেবে দাবি করে আসছে। বিগত শতকে তারা ইউরোপীয় অ্যান্টি-সেমিটিজমের শিকার বলে বারবার নিজেদের ন্যায্যতার কথা তোলে। হলোকাস্টকে তারা ২০২৩ সালে হামাসের আক্রমণের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে এবং সেটাই প্রচার করে বেড়ায়। 

ডকুমেন্টারিতে শিশুদের উপস্থাপনার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডা ইন্ডাস্ট্রির সুবিধাই হয়েছে বেশি। আমরা ১৩ বছর বয়স্ক আব্দুল্লাহ আল ইয়াজুরির বয়ান শুনতে পাই। সে যে বেঁচে আছে এটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ গাজায় অন্তত ১৪ হাজার ৫০০ শিশু জীবিত নয়। এই ছেলেটির বেশ কয়েকটি বিষয় আমাদের নজর কাড়ে এবং প্রমাণ করে এটি ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডার এক অংশ। সে ইংরেজি অনেক স্পষ্টভাবে বলতে পারে। অন্তত পশ্চিমা বিশ্বের নাগরিকদের কাছে আঞ্চলিকতার দুর্বোধ্যতামুক্ত ইংরেজিতেই সে বলে। এমনটি ইসরায়েলের সমর্থকদের একটি কূটচাল বললে দোষ হবে না। আব্দুল্লাহর তৃতীয় আঙ্গিক, সে নিজেকে বস্তুবাদী এবং একজন অরাজনৈতিক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ডকুমেন্টারিতে সে নিজে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রের ভূমিকাই যেন পালন করে। এমনকি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়েও সেই প্রধান মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। শুধু আব্দুল্লাহর একটি উক্তির সঙ্গেই কেউ অসমর্থন দিতে পারে না যখন সে বলে, ‘যদি আপনার পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়া হয় তখন আপনি কী করবেন ভেবে দেখেছেন?’

বিবিসি টেলিভিশনে ফিলিস্তিনিদের যে স্বর আসে তার মধ্যে আব্দুল্লাহর সম্পর্কে আরও জানা যায়। তার বাবা হামাস পরিচালিত সরকারের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। এই সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর ডকুমেন্টারিটি প্রমাণ করতে চাচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা তাদের কাঙ্ক্ষিত সমাধানটিই পেয়ে গেছে। আর এমনটিই পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে ইঙ্গিত করে। কারণ আব্দুল্লাহর বাবাকে ব্রিটেনের মিডিয়া হামাসের প্রধান, জঙ্গিসহ নানা ভূষণে ভূষিত করেছে। অথচ গত মাসেই মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে আমরা দেখিয়েছি, ইয়াজুরির রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের বদলে বৈজ্ঞানিক ব্যাকগ্রাউন্ডই প্রধান। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটিতে তার একটি পিএইচডি রয়েছে। গাজায় যদি যুদ্ধের পর কোনো সরকার গঠন করা হয় তাহলে ইয়াজুরির মতো টেকনোক্র্যাটদেরই সেখানে ঠাঁই পাওয়ার কথা। 

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কাছে এখনও টেকনোক্র্যাট, প্রফেসর, মেডিক, সাংবাদিক কিংবা ত্রাণ সরবরাহকারী, সবাই নিশানা। পেশাদার ব্যক্তিদের ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে। আর এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেমন ব্রিটেনের কাছে ইয়াজুরির মতো টেকনোক্র্যাটদের যুদ্ধপরবর্তী গাজার নিয়ন্ত্রণের একটি ছুতো হিসেবে বিবেচনা করতে দেখা যায়। বিবিসির ডকুমেন্টারিতে আমরা একবারও ইসরায়েলের মূল ভাবনাটিকে উপস্থাপন করতে দেখি না। ইসরায়েল ভাবে, গাজার মানুষ অপরাধী এবং তাদের সবাইকে সরিয়ে দিতে হবে। হামাসসহ আল কাসেম ব্রিগেডের সদস্যদের একই সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

বিবিসির ডকুমেন্টারিতে হামাসের প্রভাব আছে এমনটি বলা যাবে না। কারণ স্ক্রিপ্ট লন্ডনে বসে লেখা হয়েছে। যদি হামাসের হাত থাকত তাহলে ডকুমেন্টারিতে এমন বয়ান আসত না, ‘ওরা আমাদের ছেলে, বাবাদের খুন করেছে। আর সিনওয়ার মাটির নিচে লুকিয়ে আছে।’ আমরা এমন বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে চাই না। বরং দেখতে চাই, আসলেই কী বিবিসি ফিলিস্তিনিদের মূল আকুতি তুলে আনতে পেরেছে কি না। কারণ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে এসেছে। আমরা তাদের কার্যক্রম দেখতে পেয়েছি প্রতিদিন। ফিলিস্তিনি সমাজে শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের রাজনৈতিক বিশ্বাস অন্ধভাবে অনুসরণ করে না। এজন্যই বাবাকে হামাসে আর সন্তানকে ফাতাহ সংগঠনে খুঁজে পাওয়া যায়। বিবিসির মতো একটি সংবাদমাধ্যমের বৈশ্বিক দায় রয়েছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনÑ উভয় পক্ষের জন্যই একই ধরনের সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণ করা জরুরি। কিন্তু তারা সেটি করেনি। 

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের এক বছর পরও বিবিসি একটি ডকুমেন্টারি করেছিল। নোভা মিউজিক ফ্যাস্টিভেলে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের নিয়ে আয়োজন। উই উইল ড্যান্স এগেইন ডকুমেন্টারিটি হৃদয়কে আকুল করার মতো একটি ফিল্ম ছিল। ওই ডকুমেন্টারিতে কেউ ভুলেও সাক্ষীদের পিতামাতা কী করতেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। কোনো পুরুষকেই প্রশ্ন করা হয়নি, তারা সেনা হিসেবে কী কী করেছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় একটি রক ফেস্টিভ্যালে আক্রমণের ঘটনায় বেসামরিক নাগরিক আহত-নিহত হওয়ার ঘটনায় ‘হত্যাযজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু গাজার ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে গাজায় ৪৬ হাজার ৮০০ জন ফিলিস্তিনি ‘মারা’ গেছেন। এই ডকুমেন্টারিতে ভিন্ন এক ধরনের কৌশলও ব্যবহার করা হয়েছে। 

আমাদের এবার একটু এই যুদ্ধের মাত্রা দেখা জরুরি। ইসরায়েল এই যুদ্ধে প্রতিনিয়ত হামলা চালিয়ে গেছে। তারা এই যুদ্ধে একের পর এক অপরাধ করে গেছে। তারা গাজায় পানি, বিদ্যুৎ এবং যেকোনো সহযোগিতা রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এসব বিষয় মূলধারার মিডিয়ার নীরবতা ছাড়া কোনোভাবেই করা সম্ভব না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয়তে কর্মরতরা ভালোভাবে চিহ্নিত করতে পারবে। সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সার্বিক সুরটি আসেনি। বরং আমরা খণ্ডিত চিত্র পাই। 

অল্প কয়েকটি ডকুমেন্টারিতেই আমরা ফিলিস্তিনিদের সার্বিক সুরটিকে পাই। যেমন ‘নো আদার ল্যান্ড’ নামক একটি ডকুমেন্টারি করেছিলেন বাসেল আন্দ্রা এবং ইসরায়েলি সাংবাদিক ইয়ুভাল আব্রাহাম। তারা নিজেদের গ্রামের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাচ্ছিলেন। তাদের ফিল্মটি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পায় এবং পরে অস্কারও পায়। বিবিসি তাদের ডকুমেন্টারি চার দিনে সংগ্রহ করেছে। আর ওই ডকুমেন্টারিটির ফিল্মিং শুরু হয় ২০১৯ সালে। আটটি ফিলিস্তিনি গ্রামে মোট ১০০০ বাসিন্দা তাদের অধিকার ধরে রাখার আকুতি এই ফিল্মে দেখিয়েছেন। নারীরা সেনাদের মুখে পড়ে। স্কুলে পাঠদানের সময় আচমকা বুলডোজার এসে গুঁড়িয়ে দেয়। একজন ফিলিস্তিনি নারী যখন ইসরায়েলি সেনাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার কি লজ্জা করে না একটা স্কুল এভাবে ভেঙে দিচ্ছেন?’ ওই সেনা উত্তর দেয়, ‘এটা হলো আইন। আমার লজ্জা করবে কেন?’ আরেক নারীকে জিজ্ঞেস করা হয়, সে কেন সরে যাচ্ছে না। তখন সে জানায়, তার আর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। হামাসের আক্রমণের আগে ফিল্মটির রেকর্ড সম্পন্ন হয়। কিন্তু ২০২৩-এর আগেও ইসরায়েলের নানা অত্যাচার এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়। 

মজার বিষয়, ইসরায়েলি কোনো প্রোপাগান্ডাই এখন আর কাজে আসছে না। পশ্চিমা মিডিয়া এখন যেভাবেই তা উপস্থাপন করুক না কেন, এমনটি তাদের বিরুদ্ধেই এসে পড়ছে। পরবর্তী প্রজন্ম এই ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ দেখতে পাবে। সব প্রমাণ রয়েছে। তখন তারা তাদের পিতামাতাকেই প্রশ্ন করবে, ওই সময় তোমরা কী করছিলে? যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা দেখছি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ৫৯ শতাংশ সমর্থন বেড়েছে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে যা ১৬ পয়েন্ট বেশি। আবার ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন ১৪ পয়েন্ট কমেছে। মাত্র ৪৬ শতাংশ মার্কিনি এখন ইসরায়েলের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি জানাচ্ছে। গত এক দশকের সংঘাতের ফলে সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ইসরায়েল এবং তাদের সমর্থকরা কেন এখন অনেক উত্তেজিত তা বোঝা যাচ্ছে। কারণ তারা ইতিহাসের একদম উলটো পিঠে অবস্থান করছে। এই যুদ্ধ যখন একেবারে শেষ হবে তখন ফিলিস্তিনিদের স্বর আস্তে আস্তে উঠে আসবে। তখন উদার পশ্চিমা মিডিয়ার অন্ধকার দিকগুলো সবার নজরে আসবে। 

মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর : আমিরুল আবেদিন

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা