আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৫ ০৯:৫৫ এএম
আনু মুহাম্মদ
৫৮ শতাংশ মানুষ চলতি বছরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। এর মধ্যে ৩১.৬ শতাংশ আগামী জুনেই নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে আর ২৬.৫ শতাংশ নির্বাচন চায় ডিসেম্বরে। ইনোভিশন বাংলাদেশ নামে একটি গবেষণা সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত ‘জনগণের নির্বাচন ভাবনা’ শীর্ষক গবেষণা জরিপের তথ্য উঠে এসেছে ৯ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক ধরনের ঘেরাটোপে আটকে ছিল। তার ফলাফল হিসেবে ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেখতে পাই। এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৫ বছর জেঁকে থাকা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। তারপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারে তরুণদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি যোগ্য ও শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন ও পূর্ববর্তী প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতার কারণে তাদের সংস্কারের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেনি। বিষয়টি স্বাভাবিক। আমরা জানি, দীর্ঘদিন প্রশাসনের কতিপয় অসাধু অন্যায্যভাবে একটি রাজনৈতিক শক্তি বা পক্ষ থেকে নানা সময়ে স্বার্থসিদ্ধি করেছে। পটপরিবর্তনের পর সে সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় তারা এক ধরনের অসহযোগিতামূলক আচরণ শুরু করে। কিন্তু চব্বিশের অভ্যুত্থানের ফলে জনতার মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠায় অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়িত হয়েছে, এ বাস্তবতাও এড়িয়ে যাওয়ার নয়। সমস্যা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত জননিরাপত্তা, প্রশাসন এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র সম্পর্কে পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক করেনি। করেনি বলেই তারা বর্তমানে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে।
আমরা দেখছি, চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে অনেকে এখনও মূল্যায়নের সঠিক মাপকাঠি খুঁজে পাননি। এটিকে একটি অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখতে হবে। কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত ধরে এ আন্দোলন শুরু হয়নি। সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এ আন্দোলন। আমরা দেখেছি, আন্দোলন দমনের জন্য শেখ হাসিনা যে হিংস্র পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ই এ আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেয়। স্বৈরাচারের ট্র্যাজেডি অনেকটা এমন, তারা বুঝতে পারে না ঠিক কোন মুহূর্তে তাদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠছে। বিদায়ি সরকার এ অভ্যুত্থান দমনের অনেক চেষ্টা চালালেও কিছুই সফল হয়নি। কারণ জনগণই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছে। আমাদের দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, দেশের মানুষই বরাবর রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য রাজপথে নেমেছে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
দেশে একেক সময় একেক আন্দোলন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগেও আন্দোলন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে আমরা দেখেছি ধর্মীয় দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় তারা প্রায়ই বিপ্লবের কথা বলত। অনেক দল সমাজতন্ত্রের কথা বলত এবং বিপ্লবের স্বপ্ন দেখত। একাত্তরের পর সশস্ত্র সংগ্রামের চেতনা পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের অধীনে দুর্বল হয়ে যায়। আমরা আশির দশকের সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলন দেখেছি। আমার ধারণা, আশির দশকের আন্দোলন অনেক বেশি পরিপক্ব ও সম্ভাবনাময় ছিল। ওই আন্দোলন শুধু স্বৈরাচারের পতন নয়, সামাজিক পরিবর্তনের বা রূপান্তরের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। ওই সময় শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়, নারী জাগরণ দৃশ্যমান হতে শুরু করে। এমনকি দলীয় ভিত্তিতে কিছু ভাগ হয়নি। আন্দোলনের জনভিত্তি অনেক শক্তিশালী ছিল। তবে সে সম্ভাবনা কাজে লাগেনি। পরে যখন সবকিছু বাদ দিয়ে এক দফার আন্দোলন শুরু হয়, তখন তিনদলীয় জোটের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে সেটার বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে যে সংকট তা আর হতো না। একানব্বই থেকে নতুন ধারা তৈরি হয়। তখন বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়েছিল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়েই আন্দোলন হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সেদিকেই ঝুঁকে আছে।
এবার আসা যায় শিল্পসংস্কৃতির কথায়। মানুষের যাপিত জীবনই সংস্কৃতির অংশ। তাই শিল্পসংস্কৃতির প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত হয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্যের ভিত্তিতে। কিন্তু এ মুহূর্তে গোটা দেশে মতাদর্শিক বিভাজন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা চলছে। সমস্যা হলো, জননিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শিল্পসংস্কৃতির ইতিবাচক প্রভাব ছড়াতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে সারা দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, একতা ও সৃজনশীলতা কাম্য ছিল তা পাওয়া যাচ্ছে না।
যেকোনো অভ্যুত্থান সফল হলে দেশের মানুষের মনে অনেক আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রকাঠামোর শৃঙ্খলে তাকে অনেকাংশে পরাধীন থাকতে হয়। নৃতত্ত্বের ভাষায়, উপনিবেশ থেকে মুক্তির বিপ্লব থেকেই বিউপনিবেশায়নের জন্ম। তবে এ বিউপনিবেশায়ন অঞ্চলভেদে আর শোষণের রূপভেদে আলাদা। আফ্রিকায় দাসপ্রথা ছিল উপনিবেশের শোষণপ্রক্রিয়া। ভারত উপমহাদেশে তা ছিল সম্পদ লুটের মাধ্যম। ফলে দুই অঞ্চলের বিউপনিবেশায়ন আলাদা। তবে বিপ্লব পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটুক না কেন, সব সময় মানুষের শোষিত থাকার ফলে যে চাহিদা ছিল তা পূরণ করার আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নটা সবার প্রত্যাশার অগ্রভাগে থাকে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত হবে জেনে মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জননিরাপত্তাÑ এ তিনটি বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। প্রতিটি বিপ্লবই ক্ষণস্থায়ী। এজন্যই বলা হয়, বিপ্লব তুমি দীর্ঘজীবী হও। অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবের ধারাবাহিকতা টেনে নিয়ে যেতে হয় রাজনৈতিকভাবে। মানুষের রাষ্ট্রের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকে অনেক। তা পূরণের জন্য তাদের অবশ্যই নির্ভর করতে হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি। অভ্যুত্থানে মানুষ যুক্ত হয় কারণ তারা জানে, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য তাদের সড়কে নামতে হবে। এজন্যই অভ্যুত্থানের পর সমাজের মানুষ বিপ্লবী নেতাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতার ওপর আস্থা রাখতে চায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ ধারাবাহিকতা ও পরিপক্বতা ধরে রাখতে না পারায় অনেক বিপ্লব বেহাত হয়েছে।
সংস্কৃতি চিরবহমান। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটÑ এসব মিলেই সংস্কৃতির বুনিয়াদ। তবে আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো ও বিশ্বব্যবস্থায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষত আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে এ ক্ষেত্রে সতর্ক নজর রাখতে হয়। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর আমরা আচমকা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং শূন্যতা লক্ষ করি। তাই একদম শুরু থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক একতা গড়ে তোলা জরুরি ছিল। দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে, আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না
থাকায় মতাদর্শিক বিভাজন বেড়েই চলেছে। বিভাজন বেড়ে যাওয়ার কারণে ভালো উদ্যোগগুলোও অনেক ক্ষেত্রে আটকে যাচ্ছে। কারণ পদে পদে প্রশ্ন এবং বিতর্ক সংস্কার কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার
অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ তারা পুরোনোর সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন করে নিজ ঐতিহ্য ধারণ করতে পারে। আর এভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো একটি সুষ্ঠু রূপ নেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলো কি এ বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? তারা কি দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতার পেছনে রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবগত বা সচেতন? অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হচ্ছে না।
আমরা দেখছি, রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। বরং দলের কর্মীরা নানাভাবে চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, দেশের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে, অনেক স্থানে মব জাস্টিসের মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অথর্ব করে তোলা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন করা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ রয়েছে, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন।
যদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা সুসংহত করা যায় তাহলে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান অর্থনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে অশান্তি বা সহিংসতাই যে পরিবর্তন আনতে পারে তা কিন্তু নয়। আন্দোলনে মানুষ কতটা জমায়েত হবে বা মানুষকে কতটা আকর্ষণ
করতে পারবে তার ওপরই নির্ভর করে এর সাফল্য বা পরিবর্তন। পাকিস্তান আমলে যেটা হয়েছিল, মানুষকে অনেক বেশি সম্পৃক্ত করা গেছে
বলেই গণঅভ্যুত্থান করা গেছে। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও কিন্তু মানুষকে অনেক বেশি আকর্ষণ করা গেছে। সেখানে হরতাল একটা মাধ্যম হতে পারে।
মূল কথা হলো, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে কতটা যুক্ত হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করে কতটা সফল হবে বিপ্লব-পরবর্তী পরিবর্তন। মূলত রাষ্ট্রে বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের বাইরে আনতে পারলে এবং স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলেই বড় পরিবর্তন আসবে। আমরাও চাই, রাজনৈতিক শক্তির হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাক। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শিক বিভাজন আমাদের দেশে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে। এ ধরনের সীমাবদ্ধতা আমাদের সব সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিচ্ছে।