× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সম্পাদকীয়

একটি নদীর মৃত্যু

হোসেন আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৫ ০৯:৫২ এএম

হোসেন আবদুল মান্নান

হোসেন আবদুল মান্নান

অনেক বছর পরে একেবারে আকস্মিক সিদ্ধান্তে সেদিন নদীটির ওপারে গেলাম। কয়েকজন অনুজ সঙ্গী নিয়ে অটোরিকশায় চেপে পার হয়ে যাই। মনে পড়ে নদীর ওপর বাঁধ হওয়ার অল্প কিছুদিন বাদে সেই কৈশোরকালে বাবার নির্দেশে একবার এক আত্মীয়ের খুঁজে গিয়েছিলাম। মধ্যে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হবে আর যাওয়া হয়নি। নদীটি আমার নিজের উপজেলা কটিয়াদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার দুটি ইউনিয়ন জালালপুর ও লোহাজুরি গ্রামাঞ্চলে আমার যাওয়ার উপলক্ষ আসেনি। ফলে একই উপজেলাধীন কাছাকাছি গ্রামীণ জনপদ হলেও কখনও এলাকাটি দেখা হয়ে ওঠেনি।

বলা যায়, বালক সত্যজিৎ রায়ের খাতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখে দিয়েছিলেনÑ

‘দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,

একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’।

সত্যিই একজীবনে আমরা শহর-বন্দর, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, দেশবিদেশের কত কিছু দেখি। কিন্তু বাড়ির কাছের সেই আরশিনগর অনেকেরই দেখা হয় না। অদেখাই থেকে যায় জন্মভিটার সবুজ মাঠ, হাওর, অবারিত আকাশ, দিগন্তে ঝুলে থাকা চাঁদ, অস্তাচলে যাওয়া সূর্যালোক আরও কত কিছু।

দুই.

নদীটির নাম পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় ব্রহ্মপুত্র মানে ব্রহ্মার পুত্র। ফলে ব্রহ্মপুত্র হয় ‘নদ’। উৎপত্তিস্থল হিমালয়, আসাম হয়ে উত্তরবঙ্গের একাংশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম স্পর্শ করে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে জামালপুর, ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ, ভৈরব হয়ে নরসিংদী পর্যন্ত বিস্তৃত। একসময়ের স্বচ্ছ জলে ছলছল এক স্রোত-বহতা নদের নাম পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। উত্তরের ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র থেকে শাখা নিয়ে দক্ষিণে গফরগাঁও, হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, কটিয়াদী বাজারের কূল ঘেঁষে ভৈরব বাজারে এসে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এককালে হাজার হাজার পালতোলা নৌকা, বোট, পাটভর্তি ট্রলার ইত্যাদি জলজ বাহন চলাচল করত। ময়মনসিংহ থেকে কাঁচা পাট মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছাতে এ পুরাতন ব্রহ্মপুত্রই ছিল অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এ নদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোটবড় হাট, বাজার। সত্যিই বাংলার ইতিহাস হলো নদীর তীরে গড়ে ওঠা বন্দর আর ছোট টাউনশিপের। একসময় আবহমান বাংলার প্রায় ৭০ ভাগ মানুষের জীবিকা ও যাতায়াত নির্ভর করত জলপথের ওপর।

তিন.

সত্তরের দশকের শেষ দিকে কটিয়াদী থানার ডান দিক বরাবর এ নদের ওপর মাটির বাঁধ নির্মাণ করা হয়; যা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল বলে পরে অনেক নদী গবেষক ও বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন। তখন স্টিল ব্রিজ না করে বাঁধ দেওয়ায় তখনকার ক্ষীণভাবে প্রবহমান নদটি গলা টিপে হত্যার আয়োজন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে অনেকবার ড্রেজিংয়ের নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দ্বিখণ্ডিতই থেকে যায়। এতে আর কখনও নাব্য ফিরে আসেনি।

মুখথুবড়ে পড়ে নদের পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্য। মাছসহ অসংখ্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। সবার চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত নদের অপমৃত্যু হলো। ভাবতেই কষ্ট বোধ হয়, একদিন পাহাড়ের ঝরনা থেকে যে নদ-নদীর উৎপত্তি হয়ে প্রকৃতি তার আপন নিয়মে উজাড় করে ঢেলে দেয় বিপুল জলরাশি। কালের ব্যবধানে এ মনুষ্য হাতেই তার সমাধি রচিত হয়। বাংলাদেশের মতন পৃথিবীর আর কোথাও একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক নদীর অকালমৃত্যু হয়নি। ১ হাজার ৩০০ নদীর বাংলাদেশ এখন শুধু কাব্যে আর কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

চার.

বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল মূলত কটিয়াদী উপজেলা প্রশাসনের (তৎকালীন থানা) সঙ্গে জালালপুর-লোহাজুরি ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে এবং দুই ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের জোর দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। 

বলা বাহুল্য, ষাটের দশকেও এ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে কেবল কটিয়াদী বাজার থেকে হাজার হাজার মণ পাট যেত মেঘনা হয়ে নরসিংদীর ইউএমসি জুট মিলস ও নারায়ণগঞ্জে। মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ ব্রহ্মপুত্রের দুই পার ছিল গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান স্পট। নৌপথে চলাচলকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের স্থলভাগ থেকে বিভিন্ন কৌশলে আক্রমণ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। নদের এক পার দীর্ঘদিন মুক্ত করে রেখেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধের সময় ব্রহ্মপুত্রের পারে জয় বাংলা বাজার নামে নতুন বাজার চালু করেছিল মুক্তিবাহিনী।

একই স্থানে আজও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের রেখাচিহ্ন রয়ে গেছে, একই সঙ্গে টিকে আছে বাজারের পাটের বড় বড় গুদামঘরের ভগ্নপ্রায় অস্তিত্ব। চিহ্ন পড়ে আছে পাটের বস্তা মাথায় নিয়ে নদের জল অবধি নিচে নামার সিঁড়ি। এসব যেন অতীত ঐতিহ্য ও কালের নিঃশব্দ স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পাঁচ.

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ হয়েছে বটে। কালক্রমে মানুষের আধিক্য, আধুনিক যানবাহনের প্রাচুর্য, এমনকি সময় মানুষের হাতের নাগালের ভেতরে এলেও জালালপুর-লোহাজুরি ইউনিয়নের আমজনতা বোধকরি খুব বেশি সরকারি অবকাঠামোগত উন্নয়নের আওতায় আসতে পারেনি। আমার নিভৃতচারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত তা-ই বলে। ওপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল 

বিভাগের অধীনে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। উপজেলা থেকে নিকটবর্তী জালালপুরে আধুনিক ইউপি ভবনেরও চিহ্ন দেখিনি। এখনও পুরোনো টিনশেড ঘরে পরিষদের কার্যক্রম চলমান। দেখলাম, লোহাজুরি ইউনিয়ন 

পর্যন্ত একটি মাত্র রাস্তা, যেন খানাখন্দে ভরা এক মৃত্যুফাঁদ। ট্যাক্সি, অটোরিকশা, হোন্ডার রাজত্ব থাকলেও রাস্তাঘাটের বেহাল চিত্র যে-কাউকে ব্যথিত ও পীড়িত করবে।

তবে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখা যায় বাঁধের ওপরে অর্থাৎ নদের খাসজমিতে বিরাট বাজার আর দোকানপাট গড়ে ওঠার মহা আয়োজনে। আজকে দুই ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ দ্রুত পার হতে পারছে এটাই হয়তো এদের আনন্দ। অথচ একসময়ের প্রমত্ত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে এসব করা হয়েছে। তা এ প্রজন্মের কাছে বড় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। দেখেছি, একদিন যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পানিতে তীরবর্তী শত শত একর জমি কৃষির আওতায় ছিল। কৃষক বারো মাস নানাবিধ ফসল ফলাত, আজ সে নদ নিজেই কৃষিজমিতে পরিণত হয়েছে। বলা হয়, নিষ্ঠুর সময় নাকি সবকিছু গিলে খায়। লুপ্ত করে দেয় পুরোনো ইতিহাসের সব স্মৃতি নিদর্শন। ধুয়েমুছে দেয় পেছনে অঙ্কিত পদচিহ্ন। আমাদের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদও বেঁচে থাকবে কেবল ভূগোলের পৃষ্ঠাজুড়ে।

  • গল্পকার ও কলাম লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা