সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫ ১১:৪৭ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
দেশের অর্থনীতি এক জটিল ঋণের ফাঁদে আটকে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশাল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বিগত সময়ে প্রবৃদ্ধির সাফল্যগাথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলেও সব ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যানের যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৬ বছরে ব্যাপকভাবে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ৭৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও মোট ঋণের পরিমাণ ও পরিশোধের চাপ উভয়ই বেড়েছে। সোমবার প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘ঋণের ফাঁদে হাঁসফাঁস অর্থনীতি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ-সংক্রান্ত ভয়াবহ তথ্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় ২ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ কোটি বা ৩ দশমিক ৬৭ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে এ ঋণের একটি বড় অংশ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে, তবে অনেক প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত রাজস্ব না আসায় ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে সহজ শর্তের ঋণের পরিমাণ কমে আসছে এবং কঠোর শর্তযুক্ত ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির জন্য আরও সংকট তৈরি করতে পারে। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট কমার আশঙ্কা রয়েছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশে বেশ কিছু বৃহৎ অবকাঠামো (মেগা প্রকল্প) প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও। বাস্তবতা হচ্ছে, সব প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত রাজস্ব আসেনি। ফলে এই খাতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরীর অভিমত, ‘অনেক অবকাঠামো প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এসব প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধে সরকারকে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে।’ এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমছে, কারণ রাজস্ব বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের বোঝা অনেক দ্রুত বাড়ছে। যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে সরকারকে নতুন ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধ করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গটি আলোচনার টেবিলে এ কারণে যে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের গড় সুদের হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৩ শতাংশে। অর্থাৎ মাত্র কয়েক বছরে সুদের হার প্রায় ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের গড় পরিশোধের সময়সীমা কমে গেছে। ২০১৬ সালে যেখানে গড় পরিশোধের সময় ছিল ১২.৩ বছর, সেখানে বর্তমানে এটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮.৫ বছরে।
আগামী কয়েক বছরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল ও মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পগুলোর ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে আসছে। তখন ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ একসঙ্গে শুরু হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঋণ ব্যবস্থাপনায় এখনই পরিবর্তন আনা না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়বে। সরকার যদি এখনই ঋণ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে আগামীতে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হবে। তাই নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে এবং সম্ভাব্যতা যাচাই করে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।
এ কথা সত্য, বাংলাদেশ অতীতে কখনও এভাবে ঋণ দুর্দশায় পড়েনি। ঋণের এ চাপ সার্বিক বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ডলারের সংকট প্রকট হচ্ছে, দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর টাকার মান কমায় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও। উদ্বেগের বিষয়, ঋণ পরিশোধে রিজার্ভে ডলারের টান কমাতে ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি করের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের দিকে মনোযোগী হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারকে আগামীতে ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’র মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। মেগা উন্নয়ন প্রকল্পে আপাতত রাশ টানতে হবে। চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দু-তিন গুণ ব্যয়ে সম্পন্ন করার প্রবণতা ত্যাগ করে মিতব্যয়িতার পরিচয় দিতে হবে। তবে ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমাদের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বোঝা না বাড়িয়ে তা পরিশোধে যত্নশীল হতে হবে। এ চ্যালেঞ্জিং সময়ে এসব উদ্যোগ সামগ্রিক বিনিয়োগে অর্থসঞ্চালন বা প্রবাহ বৃদ্ধি আমাদের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পূর্বধারায় ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে। আমরা মনে করি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার ঋণনির্ভর না হয়ে স্বাবলম্বী অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দেবে, এটাই আমাদের পরামর্শ।