সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৮ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হঠাৎই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চরমপন্থিরা। তারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। গত দেড় যুগে এ অঞ্চলে চরমপন্থিদের তৎপরতা খুব একটা দেখা যায়নি। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতার অভাব দৃশ্যমান হতেই চরমপন্থিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে থাকা চরমপন্থি সংগঠনের সদস্যরা এখন প্রকাশ্যে। পাশাপাশি কারাগার থেকে জামিন নিয়েও অনেকে বেরিয়েছেন। খোলস পাল্টে এলাকায় একক আধিপত্য নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে অনেকে। ফলে এ জনপদে দেখা দিয়েছে রক্তপাতের শঙ্কা।
৭ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদে রক্তপাত ফেরার শঙ্কা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা রীতিমতো শঙ্কা ও আতঙ্কের। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, নড়াইল, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, খুলনা, বরিশালসহ আরও কয়েকটি জেলায় চরমপন্থি বিভিন্ন সংগঠনের আধিপত্য বিরাজ করছে। তাদের কেউ রিকশা ও রিকশা-ভ্যানচালক, কেউ সবজি বিক্রেতা, কেউ মুদি দোকানি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নানা অভিনব কায়দায় সুযোগ বুঝে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। বিভিন্ন সময় তারা অস্ত্র ছিনতাই, পুলিশের ক্যাম্প লুট, প্রতিপক্ষের অস্ত্রভান্ডার লুটসহ নানা অস্ত্রে সমৃদ্ধ হচ্ছে। সেভেন মার্ডার, ফাইভ মার্ডারসহ বিভীষিকাময় নানা হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক পর ঝিনাইদহে সাম্প্রতিক ট্রিপল মার্ডার নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় আবারও আতঙ্ক দানা বাঁধছে একসময়কার চরমপন্থি অধ্যুষিত জনপদটিতে। খুলনায় একসময় চরমপন্থিদের তৎপরতা দমন করা হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে।
৯ জানুয়ারি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কাছে হোটেল সিগালের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় খুলনার সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপুকে। ৩১ জানুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার তেকালায় নির্মাণাধীন সেতুর শ্রমিকদের ছাউনিতে বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি, ২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে বাউন্ডারি ওয়ালে গুলি ছোড়া, ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার গড়াই ব্রিজের বালিরঘাটে সবুজ নামে এক ব্যক্তিকে গুলি এবং খুদে বার্তায় চরমপন্থিদের দায় স্বীকার অপরাধীদের বিস্তারের কথাই তুলে ধরে।
এমন অবস্থার পেছনে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে যাওয়া। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলগুলোর স্থানীয় নেতারা এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফলে সন্ত্রাসীরা তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার। সে সময় চরমপন্থিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। সরকারের ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ২ হাজারের বেশি চরমপন্থি অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আবারও এ অঞ্চলের জেলাগুলোতে চরমপন্থিদের উপদ্রব বাড়ে। ২০০৪ সালে র্যাব গঠিত হওয়ার পর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে চরমপন্থি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। র্যাব-পুলিশের অভিযানে কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অন্তত দেড় হাজার চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করেছে এবং এ সময় আধিপত্য নিয়ে চরমপন্থিদের হাতে চারশর বেশি মানুষ নিহত হয়।
এ কথা সত্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বিভিন্ন সুযোগসন্ধানী চক্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার মাশুল গুনতে হয় শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষকে। চরমপন্থিরা যখন খুন, চাঁদাবাজি, লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে তখন তাদের আদর্শ বলে কিছু থাকে না। যারা স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ফিরে আসেনি, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অতীতে দেখা গেছে, চরমপন্থিরা সব সময়ই কোনো না কোনো প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক দলের ছায়ায় সক্রিয় থাকার চেষ্টা করত। এখন দেখার বিষয়, অতীতের মতো স্থানীয় প্রভাবশালীরা আবারও নিজেদের হীনস্বার্থে এ বিপথগামীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে কি না। আমরা মনে করি, প্রশাসন তো বটেই, সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং রাজনীতিকদেরও চরমপন্থিদের নিষ্ক্রিয় করার দায় রয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন। কোনোভাবেই চরমপন্থি-উগ্রবাদী কিংবা জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম অভিযান পরিচালনা জরুরি। চরমপন্থিদের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের ওপরও জোর দিতে হবে। অনেক সময় অপরাধীরা কৌশল পাল্টিয়ে নিজেদের সুরক্ষাবলয় সৃষ্টির পাশাপাশি গোপন কার্যক্রমে সক্রিয় থাকে। চরমপন্থিদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস সন্ধানক্রমে মূলহোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থায় প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো মূল্যে চরমপন্থিদের রুখতে হবে।