× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিক্ষা ও শিক্ষকতা

পেশানির্ভর সমাজবিন্যাসে অনিবার্য বাস্তবতা

ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৩ এএম

ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা

ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা

স্বাভাবিকভাবে মানুষ লব্ধজ্ঞান দ্বারা শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে এবং যাপিত জীবন সচল ও সজীব রাখে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পেশার রকম ভিন্ন হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সর্বজনীন এবং অনেকটা অভিন্ন। পৃথিবী বাসযোগ্য হওয়ার পর মানুষ এ গ্রহে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানাবিধ কৌশল ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে। প্রথমত প্রাকৃতিক কারণে মানুষকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ঝড়, ঝঞ্ঝা, বন্যা, খরা, শীত ইত্যাদি আবহাওয়াগত বিরূপ পরিবেশের পাশাপাশি বন্য হিংস্র জন্তুর সঙ্গে মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে। লড়াই করতে হয়েছে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের উপায়কে স্থায়ীরূপ দেওয়ার নিমিত্ত। প্রাগৈতিহাসিক নানা স্তর পার হয়ে সাহসী মানুষ আজ বিশ্ব সভ্যতা গড়ে তুলেছে। আর আধুনিক বিশ্ব গড়ে তোলার প্রধান নিয়ামকস্বরূপ মূর্তমান হয়ে আছে শিক্ষা-শিক্ষকতা।

পেশার শ্রেণিবিভাজনে শিক্ষকতাও পেশা। যারা শিক্ষা প্রদানের সঙ্গে জড়িত তারা জৈবিক মানুষ। সমাজের সংশ্লিষ্ট বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে এঁরা পৃথগন্ন। কিন্তু দীর্ঘ চর্চিত, উচ্চারিত, প্রচলিত একটি প্রবচন হলোÑ শিক্ষকতা পেশা নয়, একটি মহান পেশা। রাষ্ট্রের একক মানুষ। মানুষে মানুষে মিলে গড়ে ওঠে সমাজ, রাষ্ট্র। বহু মত আর বহু পথের মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠে একটি জনগোষ্ঠী। সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় এ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অনুমোদন করে। পেশানির্ভর সমাজবিন্যাস হয়ে ওঠে অনিবার্য বাস্তবতা। প্রাচীনকালে যখন শুধু ক্ষুধা নিবারণই ছিল মানুষের একমাত্র আরাধ্য, তখনও ভিন্ন ভিন্ন পেশাভিত্তিক জনগোষ্ঠী ছিল। প্রাকৃতিক ফল ছাড়াও কৃষি, মাছ শিকার, পশু শিকার ইত্যাদি ছিল সে সময়ের খাদ্য সংগ্রহের প্রধানতম উপায়। এসব কাজ সহজ করার জন্য আবার গড়ে ওঠে কামার, কুমার, তাঁতি প্রভৃতি কর্মমুখী জনগোষ্ঠী। এ সময়ের ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভূমি। মগজ ব্যবহার করে পেশা নির্ধারণের চেয়ে পেশিশক্তির ব্যবহার এ সময়ের শ্রমবিভাজনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বুদ্ধির লালন, বিকাশ এবং ব্যবহার মানুষ আয়ত্ত করে প্রাকৃতিক নানামাত্রিক বিরূপতার কারণে। জীবনকে যাপনের জন্য মানুষ প্রস্তর, লৌহ, ব্রোঞ্জ, স্বর্ণ ইত্যাদি যুগ অতিক্রম করে প্রযুক্তির ব্যবহার উদ্ভাবনে সক্ষম হয়। কৃষির উৎকর্ষতায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিকাশে, বাস্তুসংস্থাপনে মানুষ তার বুদ্ধির উন্নততর স্তর ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। আদিম, প্রাচীন, মধ্য ইত্যাদি যুগ পার হয়ে মানুষ আধুনিক যুগে মগজ ব্যবহার করতে শুর করে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফলতা লাভ করে। বলা হয়, এসব সাফল্যের প্রধানতম নিয়ামক শিক্ষা।

প্রাকৃতিক উপায়ে গৃহীত শিক্ষা মানুষকে ক্রমান্বয়ে কৌতূহলী করে। এরা মৃত্তিকার বন্ধন মুক্ত করে শূন্যে ডানা মেলতে চায়। জলের অতল গহ্বরের রহস্য উন্মোচনে উন্মনা হয়। নিরন্তর সাধনা আর ত্যাগের সর্বোচ্চ মাত্রায় মানুষ তার দীর্ঘকালীন আচরণিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে সক্ষম হয়। শিক্ষা এ পারঙ্গমতার প্রধান নিয়ামক। প্রগতি, সত্য, সুন্দর ইত্যাদি শিক্ষার মৌল বৈশিষ্ট্য। মেধার লালন, বোধের বিকাশ, চেতনার স্ফুরণ সবই সম্ভব শিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট আত্তীকরণে। শিক্ষা বায়বীয় কোনো উপাদান নয়। শিক্ষার উৎকর্ষতা, অপকর্ষতা অথবা নিকৃষ্টতা যথাযথ মাধ্যমের ওপর অনেকটা নির্ভর করে।

মগজ থেকে মগজে, বোধ থেকে বোধে শিক্ষার সঞ্চারণ যিনি ঘটান তিনি শিক্ষক। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সমাজে সমাদৃত, সম্মানীয়, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ব্যক্তি শিক্ষক। মানুষকে তার জন্মকালীন অবস্থা থেকে জাগতিক অথবা ইহজাগতিক চেতনা জগতে উত্তরণ ঘটান শিক্ষক। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ গঠনের প্রধানতম নিয়ামকও শিক্ষকই।

একুশ শতকে প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় যার ভূমিকা মুখ্য, আগামী পৃথিবী বিনির্মাণে যিনি অগ্রসৈনিক তিনি সর্বজননমস্য শিক্ষক।

শিক্ষক তার জীবন নির্বাহের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেন। স্ত্রী, পুত্র, স্বজন লালনপালনের নিমিত্ত অষ্টপ্রহর ভাবতে থাকেন। শোভন প্রচেষ্টা সমাজে প্রশংসনীয়। সমাজ কাতর হয় তখন যখন শিক্ষক তার পেশার স্বাভাবিক আচরণের সীমা অতিক্রম করেন। শিক্ষা বিতরণের নামে ঘরে ঘরে গিয়ে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলনের সম্মোহনী বাণী প্রচারের আড়ালে অর্থ প্রাপ্তির গোপন বাসনা আলংকারিক ব্যঞ্জনায় আপাতসুন্দর মধুরতায় চরিতার্থ করেন। ষষ্ঠেন্দ্রিয়সম্পন্ন মানুষ যখন সবিস্ময়ে অবলোকন করে জ্ঞানের দিশারি, তিমিরবিদারী, পথনির্দেশী কোমলমতি বিদ্যাপ্রার্থীর দুর্বল মগজের অজুহাতে ভয়সঞ্চারী বাক্য প্রস্রবণে নিরীহ অথবা নিরুপায় প্রতিপালনকারীকে তার উত্তরাধিকারিকে উত্তমযোগ্য মর্ত্যবাসী করার লক্ষ্যে অকাতরে অর্থব্যয়ে আকৃষ্ট করেন অথবা বাধিত করেন তখন মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো অসহায়ভাবে কাতরানো ছাড়া আর কোনো 

উপায় থাকে না।

জাতি শিক্ষকের কাছ থেকে কেবল পেশানির্ভর আচরণ প্রত্যাশা করে না। পেশা সময় নির্ধারিত একটা ধারণা। দৈনিক আট ঘণ্টা হিসেবে শ্রমবিনিময়ে অর্থোপার্জনের মৌল তাগিদ শিক্ষকতায় নেই। একজন শিক্ষার্থীর বিষয়জ্ঞান স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষক তাকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে শিক্ষক সর্বদা নীতি-নৈতিকতার মর্মবাণী প্রচার করে থাকেন। সাধারণ মানুষ যেকোনো সংকটে শিক্ষকের পরামর্শ গ্রহণ করে। ইত্যাকার কাজের জন্য শিক্ষক কোনো প্রকার পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না। বিষয়গুলো নিতান্তই শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। শিক্ষকদের এ সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি। জাতি বা রাষ্ট্র যে সম্মানের চোখে শিক্ষকদের দেখে তাদের নিজেদের তাগিদে এ সম্মান ধরে রাখা বাঞ্ছনীয়।

স্মরণযোগ্য, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ধর্মবর্ণনির্বিশেষ সবার শিক্ষাগ্রহণ কর্তব্য। একটি পরিবারের, সমাজের অথবা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব শিক্ষায় বিনিয়োগ করা। এ বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নয়, এ বিনিয়োগ হওয়া উচিত সময় প্রদানে, গবেষণায় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও। সন্তান কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে; এর পরিবেশ-প্রতিবেশ কেমন, ঘরে ফিরে পড়ার টেবিলে বসে অধ্যয়ন করছে না আধুনিক প্রযুক্তির অপকৌশল আয়ত্তে সময় নষ্ট করছে এসব বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন থাকা আবশ্যক। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা গৃহশিক্ষক সন্তানের পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে এমনটা ভাবা অভিভাবকদের উচিত নয়।

জনবহুল বাংলাদেশ। বিপুল এ জনগোষ্ঠী দেশকে সংকটের আবর্তে নিপতিত না করে অগ্রগতির চালিকাশক্তি হতে পারে শিক্ষার যুগোপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭-তে স্পষ্ট বলা আছেÑ ক. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য। খ. সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য।

রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালনে অক্ষম হতে পারে না বা এ দায় অস্বীকার করতে পারে না। বাস্তবতা হলো, জনসম্পদ জনশক্তিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা মুখ্য সেই শিক্ষকদের প্রসঙ্গে রাষ্ট্র উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে পুরোপুরি সক্ষম হতে পারছে না। শিক্ষার আধুনিকায়ন, দেশি পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রায়োগিক শিক্ষার উদ্ভাবন, বিশ্বনাগরিক গড়নে জাতীয় চেতনার সঞ্চারণ সর্বোপরি শিক্ষকদের আর্থিক সক্ষমতা প্রদানে রাষ্ট্রকে আরও বাস্তবানুগ হওয়া কর্তব্য।

মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষক শুধু ব্যক্তি অভিধা নয়, একটি গোষ্ঠীর ধারক। ব্যক্তিবিশেষের ভুল অথবা বিচ্যুতি গোটা শিক্ষকসমাজের নয়। এখনও শিক্ষকই জলকাদামগ্ন গ্রামীণ সাধারণ মানুষের সন্তানের সামনে বিদ্যার দ্বার উন্মোচন করেন। অর্থনৈতিক দীনতার তীব্র পীড়নের অর্গল ভেদ করে দেশের বৈচিত্র্যময় জনপদে শিক্ষার আলোক বিতরণ করেন। ঈদ-পার্বণ, উৎসব-আয়োজনে করপোরেট সমাজব্যবস্থা যখন কসমেটিকস জীবনযাপনে অগ্রসরমান তখনও আমাদের শক্ত, ভদ্র, বিনীত, সংযমী, বিনম্র শিক্ষক স্ত্রী-সন্তানদের যৎকিঞ্চিত উপহার অথবা চাহিদা পূরণ করে শিক্ষা বিস্তারে একটুও পিছপা হন না, হননি, হবেনও না।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা