অবকাঠামো উন্নয়ন
কাজী রবিউল ইসলাম
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৫ ১০:০৯ এএম
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৫ ১০:০৯ এএম
কাজী রবিউল ইসলাম
বিগত এক দশকে দেশে একাধিক মেগা প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। অধিকাংশ মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে অধিক ব্যয়ের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু রাজধানীতে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পাশাপাশি সড়কের আধুনিকায়ন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এগুলোর অবদান জিডিপিতে আছে। ফলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন বিস্ময়কর কোনো বিষয় নয়। তবে এগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে গেলে সময় দেওয়া প্রয়োজন। এসব মেগা প্রকল্পের ফলে যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঢাকা থেকে অন্য অনেক জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে। এর ফলে কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও তা আমাদের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় পর্যাপ্ত নয়। এখন প্রয়োজন বিনিয়োগ। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হয় ঠিকই কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পর যদি বিনিয়োগ না আসে তবে প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। এ কথা মনে রাখতে হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন মূলত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গতি সঞ্চারের জন্যই করা হয়। পটপরিবর্তনের পর দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উৎপাদনে এক ধরনের শূন্যতা দেখা দিয়েছে। এ শূন্যতা আরও দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে।
সংগত কারণেই দেশে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় এবং তা যদি পূরণ করতে হয় তাহলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রধান কাজ হতে হবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কতগুলো অর্থ আছে। এক. কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া, শিল্প উৎপাদনমুখী হওয়া। শিল্পনির্ভর হওয়ার ফলে অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ে। কারণ ধর্মঘট কারখানায়ই হয়, কৃষিজমিতে ফলন কখনও ধর্মঘটের কারণে বন্ধ করা যায় না। দুই. নগরায়ণ হচ্ছে আর তিন. যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠছে। এই তিনের বিচারে যদি বলা যায় তাহলে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর মানুষ যখন বয়স্ক হবে তখন তার পেনশন প্রয়োজন হবে এবং এটি গুরুত্বপূর্ণও বটে। এরই মধ্যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু রয়েছে। কিন্তু বিষয়টিকে সব পর্যায়ে স্বচ্ছভাবে পৌঁছে দেওয়ার কাজ এখনও বাকি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে চাই না। সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি সাহায্য পাওয়ার জন্য। অথচ সহায়তা দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ টিকে থাকতে পারে না। তখন অনেক সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হবে। সুতরাং প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন নিজেদের উদ্ভাবন ও দক্ষ শ্রমিক। এগুলো পারস্পরিকভাবে জড়িত। মধ্য আয়ের ফাঁদে সেসব দেশ পড়েছে যারা এ তিন বিষয়ের সমন্বয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে এটি কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য হয়েছে। বাকি কাজ অর্থাৎ দক্ষতা ও বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে আমরাও ওই ফাঁদে পড়ব।
আমাদের দেশের আরেকটি বড় সমস্যা, দেশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বিশেষ করে তরুণরা সুযোগ পেলেই বিদেশ চলে যাচ্ছেন। তরুণদের ধরে রাখতে না পারা একটি দেশের জন্য শঙ্কার বিষয়। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়। আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও ভুটানেও একই অবস্থা। ভুটানের মতো একটি সুখী দেশেও তরুণরা বাইরে যাচ্ছেন। তরুণ সমাজ একটি সুন্দর জীবন চাইছে। এ সুন্দর জীবন তৈরি করতে দরকার আয় ও ভালো চাকরি। ভালো জীবনের পরিবেশ তৈরির জন্য দেশের সরকার ও অর্থনীতির অগ্রগতি সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা যতক্ষণ পর্যন্ত তরুণরা বুঝতে না পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা দেশে ভয় পাবেন। তাদের জন্য এ পরিবেশ তৈরি না হলে তারা মনে করবেন, আমরা দেশে থেকে কী করব? তাদের জন্য দেশকে সেই স্বস্তিটা তৈরি করে দিতে হবে। আমরা সবাই চিন্তা করছি মূল্যস্ফীতি নিয়ে। কিন্তু উন্নয়ন অধ্যয়নের নিরিখে অবকাঠামোর সঙ্গে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিÑ এ দুটোতেই বাড়তি মনোযোগ জরুরি। আমরা যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করি এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজ দিতে না পারি, আর বিনিয়োগ যদি না হয় তাহলে কাজ হবে না। আমরা শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ে কথা বলছি। অথচ তুরস্ক ১০ বছর ধরে ৬০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বসবাস করছে। এরপরও তুরস্কের অর্থনীতি কিন্তু উন্নত হয়েছে। এখন সামষ্টিক অর্থনীতির অনেক অর্থনীতিবিদ চিন্তা করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে যারা কথা বলে সেটা এখন ম্যাচিউর বা পরিপক্ব অর্থনীতির জন্য সত্য। আমরা এখনও ম্যাচিউর অর্থনীতি না। আমাদের অর্থনীতির প্রধান কাজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। তারপর আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যাব।
বাজেটে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিয়ে কোনো কথা বলছি না। অথচ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরাসরি পলিসি থাকা উচিত। কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয় পলিসি নিয়ে আসা উচিত ছিল। তবে স্রেফ কাজের জন্য কাজ তৈরি নয়, অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা রাখতে সক্ষম এ রকম শ্রমসৃজন পলিসি দরকার ছিল। আমাদের অর্থনীতির একটি প্রধান ভিত হচ্ছে রেমিট্যান্স। অথচ বিদেশে পাঠানো ৫৭ শতাংশ শ্রমিকই অদক্ষ। দেশের সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ শ্রমশক্তি পাচ্ছি না কেন? দক্ষ শ্রমশক্তি পেতে আমাদের করণীয় কী? এটি কঠিন প্রশ্ন। উদাহরণ হিসেবে আমাদের ড্রাইভারদের কথা বলা যায়। দেশে ড্রাইভিং কোর্স পাস করে কুয়েতে গিয়ে চাকরি পাচ্ছে না। কারণ, সে ড্রাইভিং জানে না। আমরা এমন এক রাজধানী তৈরি করেছি যেখানে ট্রাফিক লাইট নেই। আবার ট্রাফিক লাইট থাকলেও কেউ মানবে না, পুলিশও সেটা মানাতে পারে না। ট্রাফিক আইন ঠিকমতো জানা ও মানার অভাবে পুলিশ নিজেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাহলে এদেশের ড্রাইভার বাইরে গিয়ে কীভাবে চাকরি পাবে? দেশে যদি ভালো ড্রাইভার না থাকে, তাহলে বিদেশে পাঠাব কীভাবে? দেশে যদি ভালো ইলেকট্রিশিয়ান না থাকে তাহলে বিদেশে পাঠাব কীভাবে? সুতরাং দক্ষ জনশক্তি তৈরি এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে আমাদের চিন্তা করা উচিত। পরীক্ষাভিত্তিক সিস্টেমের সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ এটি কেবলই পরীক্ষায় পাস, দক্ষতার ছাড়পত্র নয়। বলা হচ্ছে প্রযুক্তির হাত ধরে আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে। এর জন্য আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রস্তুতি কেমন? এ ব্যাপারে আমাদের তরুণদের অবস্থান খারাপÑ এমনটা মনে করি না। কম্পিউটার সায়েন্সে যারা রয়েছেন তারা কিন্তু খারাপ করছেন না। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই বাইরে চাকরি করতে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু দেশে যারা আছেন তাদের দক্ষতা ও প্রস্তুতি আছে কি না, সেটা ভিন্ন জিনিস। কম্পিউটার সায়েন্সে যারা দক্ষ তারা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশে চাকরি নেই। কিন্তু আমরা মেশিন লার্নিং বলি, মেশিন লার্নিং বলতে কী অর্থ সেটা তো আমরা বুঝছি না। ডেটাবেজে আমাদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই।
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮০-৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক খাতনির্ভর হয়ে আমরা কীভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হব? আনুষ্ঠানিক খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার? আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের ধরে রাখা উচিত। আমরা যদি সঠিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা দিতে পারি, তাহলে তারা দেশে থাকবে। সঠিক সুযোগ-সুবিধা বলতে শুধু মুখের কথা দেওয়া নয়, বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ বাড়ানো উচিত, যাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। বড় অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগ ছাড়া আনুষ্ঠানিক খাত সম্প্রসারণ করা দুষ্কর। আমাদের পলিসি নিতে হবে, যাতে আগামী ১৫ বছর দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এতে দেশেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে। যেমন দেশের প্রথম ফ্লাইওভার (মহাখালী ফ্লাইওভার) বিদেশি প্রকৌশলীরা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে শিখে এখন দেশীয় প্রকৌশলীরাই ফ্লাইওভার বানাতে পারছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিদেশিদের সঙ্গে বাংলাদেশের লোকজনও সম্পৃক্ত ছিল। এক সময় হয়তো তারা এ মানের কিংবা কাছাকাছি মানের সেতু তৈরিতে সক্ষম হবেন। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, রক্ষণশীল চিন্তা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমাদের বাজার আছে, শ্রমশক্তি আছে; প্রয়োজন বিনিয়োগ; যাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়।