সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫ ১২:২৪ পিএম
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়’Ñ নতুনের ঝান্ডা উড়িয়ে আত্মপ্রকাশ করল নতুন রাজনৈতিক দল। যাকে প্রতিদিনের বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিবেদনে ‘রাজনীতির দিগন্তে নতুন সূর্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ঘোষণা দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করা এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তরুণ নেতৃবৃন্দ আশাজাগানিয়া অনেক কথাই বলেছেন। প্রত্যেকেই আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। তারা পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলেছেন। আমরাও প্রত্যাশা করি, যে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সেই স্বপ্ন ও সম্ভাবনা পূরণে তরুণরা তাদের রথযাত্রা অব্যাহত রাখবে। যেখানে বাংলাদেশ এবং এই ভূখণ্ডের প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। সুখী-সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেবে। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রহীনতার যে শিকল আমাদের পায়ে পরেছিল, সেই শিকল কাটতে ছাত্র-জনতা পথে নেমেছিল। অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার মুখে মুখে ফেরা ‘তুমি কে, আমি কে/ বিকল্প, বিকল্প’ স্লোগানকেই যেন মূর্ত করে তুলেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছেÑ তাদের আত্মপ্রকাশ ‘একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল’ হিসেবে। আমরা তারুণ্যের কাছে তাদের এই অবস্থানের পক্ষে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় প্রত্যাশা করি।
ছাত্ররা নতুন দিনের রাজনীতির কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, তারা কি আদৌ নতুন বন্দোবস্ত করতে পারবেন? নাকি ঘুরে-ফিরে পেছনের পথেই হাঁটবেন? প্রশ্নগুলোর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতি নিয়ে যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে এবং যে রাজনৈতিক শূন্যতাকে কেন্দ্র করে নতুন দলের উত্থান, তাতে সবার প্রত্যাশার পারদ ঊর্ধ্বমুখীÑ সেটাই স্বাভাবিক। সেই প্রত্যাশার চাপও তারুণ্য মোকাবিলায় সক্ষম হবেন বলেই প্রত্যাশা।
স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস পরস্পরকে দোষারোপের ইতিহাস। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল একে অন্যের বিরুদ্ধে তৈরি করেছে বিষোদ্গারের রাজনীতি। সেখানে কথার ঘায়ে ব্যক্তি আক্রমণ এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। উপমহাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে আমাদের দুবার পতাকা বদল হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা পাকিস্তানের অংশ হয়েছিলাম। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর ছিল না। লাঞ্ছনা, শোষণ-শাসন থেকে মুক্ত হতে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনি। উপমহাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক দল অন্য দলকে কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশপন্থি বলেও ঘায়েল করতে চেয়েছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ছিল, সকল ধরনের অধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল সেই লক্ষ্যকেই বাস্তব রূপ দিতে চাইছে। তারুণ্যের জয়ধ্বনিতে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ঠাঁই হবে না।’ তার এই ঘোষণা একদিকে বিভাজনের রাজনীতিকে যেমন অনুৎসাহিত করবে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় সবার ভেতরে দেশপ্রেমের নব অনুভূতিও ক্রিয়াশীল হবে বলে আমরা মনে করি। সেই সঙ্গে আমরা এও প্রত্যাশা করি যে, নবগঠিত রাজনৈতিক দলটি পরিচালিত হবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং দলটি তাদের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচিতেও নতুনত্বের ছাপ রাখবে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বলাকা’ কাব্যে তারুণ্যকে আহ্বান করে লিখেছিলেন, ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।/রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,/সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে/ পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।/আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।’ আমরা প্রত্যাশ করি, নতুন রাজনৈতিক দল, যে তারুণ্যের শক্তিতে নব-বলীয়ান হয়ে যাত্রা করল, যে উদ্যম ও প্রেরণা ধারণ করে তাদের অগ্রযাত্রা ঘোষণা করল, সেখানে তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র-তারুণ্যে ‘প্রত্যাশা পূরণে’ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির জন্য শুভকামনা।