× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাজার ব্যবস্থাপনা

উৎপাদক ও বিক্রেতার মাঝের স্তর ভাঙতে হবে

ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫ ১১:২২ এএম

ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা

ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা

দেশের বাজারব্যবস্থায় সিন্ডিকেট শব্দটি কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছে না। শব্দটি এ শতকের শুরু থেকেই কালোবাজারের জায়গায় থিতু হয়েছে এবং কালোবাজারের তুলনায় আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কালোবাজারের বিষয়টি আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে যে রূপে ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলেছে। এখন বাজারব্যবস্থা এমন বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে যে, পণ্যের দাম বাড়লেই সিন্ডিকেটের ওপর দোষ পড়ে। কিন্তু এ সিন্ডিকেট কী, সিন্ডিকেটের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে প্রভাব কতটুকু, এসব বিষয়ে বিস্তারিত ধারণাও পাওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে বাজারের তুলনামূলক তথ্য পাওয়া এবং তথ্যানুসারে অসঙ্গতি চিহ্নিত করার বিষয়টি নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ, বাজারে সরবরাহব্যবস্থায় এক ধরনের বড় অসঙ্গতি যে রয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ অসঙ্গতির কারণেই বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। যদিও এ বছর সবজির দাম তুলনামূলক কম। কিন্তু সবজির বাজারে পণ্যের দাম কমা আরেকটি বড় সংকট তৈরি করেছে। আমরা দেখছি, কৃষক ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পরবর্তী মৌসুমে সবজি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এরই মধ্যে আসছে পবিত্র রমজান মাস। রমজানে কিছু নির্ধারিত সবজি এবং খাদ্যশস্যের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর চাপ বাড়ে। এ সময় গৃহস্থালি খাদ্যাভ্যাসে যেমন বদল আসে তেমন পরিবর্তন আসে খাদ্য উৎপাদন ও হোটেল ব্যবসায়ও। ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ এ মাসটিতে সঙ্গত কারণেই বাজার সরবরাহব্যবস্থা সুচারু, বাজারের অসঙ্গতি চিহ্নিত এবং ঘাটতি পূরণ করার প্রাকপরিকল্পনা নির্ধারণ জরুরি। বিশেষত পটপরিবর্তনের পর যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তখন সঙ্গতই সরকারকে বাজারের বিষয়ে আরও কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে।

রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে, সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন সম্ভবত সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায়নি। আর এ বাড়তি চাহিদা পুঁজি করেই বাজারে বাড়তে শুরু করে এসব পণ্যের দাম। দেশে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ১৫ দিনের ব্যবধানে পাইকারিতে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে অন্তত ১০ টাকা। আদা-রসুনের দামও ঊর্ধ্বমুখী। খাতুনগঞ্জে দুই সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। গত শনিবার তা ছিল ৭২ থেকে ৭৫ টাকা। আর গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখানে প্রতি কেজি চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ২১৫ টাকায়। অন্যদিকে, ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে কেরালা আদা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা কেজি। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়া সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেও তা মূলত সরবরাহ ঘাটতির কারণে ঘটেনি। প্রতি বছর রমজানের ১৫-২০ দিন আগে থেকেই খাতুনগঞ্জে বেচাকেনা বেড়ে যায়। তাই স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা ব্যস্ত সময় কাটছে আড়তদারদের। আর বেচাকেনা বেড়ে যাওয়ায় রমজানের আগে বাড়তে শুরু করেছে মসলা জাতীয় পণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম। ১০ রমজান পর্যন্ত এ ব্যস্ততা থাকবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ রমজানের সময়ের ব্যস্ততার দোহাই দিয়েই পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ এমনটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। বরং এ ক্ষেত্রে সরকারকে পণ্যের দাম মনিটরিং এবং সরবরাহ সুশৃঙ্খল করতে উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু তারা যদি এক্ষেত্রে অসহযোগিতামূলক আচরণ করে কিংবা অসাধু পন্থা অবলম্বন করে তাহলে প্রয়োজন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। রমজানে বিশেষত নিম্ন আয়ের ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপর চাপ বাড়ে বেশি। তাই আমাদের অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা বিবেচনায় বৈশ্বিক অর্থনীতির সম্ভাবনার চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারের শৃঙ্খলা ফেরানোই বেশি জরুরি।

সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধের ঘোষণা সব সরকারের তরফেই জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে সিন্ডিকেট বন্ধের কার্যকারিতা দৃশ্যমান নয়। সিন্ডিকেটের টিকি ধরা কি এতই কঠিন? দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় সবজির কারণে কিছুটা স্বস্তি এসেছে বটে। কিন্তু রমজান উপলক্ষে দাম বাড়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ইতঃপূর্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের জীবন দুঃসহ হয়ে পড়েছে। বাজারদর মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও ক্রেতার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। পণ্য পরিবহন সিন্ডিকেট ও যাদের হাত ঘুরে বাজারে পণ্যসামগ্রী আসছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ না হলেও সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থার কড়া নজরদারিই এর লাগাম টেনে ধরতে পারে। এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা লক্ষ্য করি, দাম বাড়ার ক্ষেত্রে মিল মালিকরা বলেন, ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে। বাস্তবে কতিপয় অসাধু মিল মালিক চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন, এমন অভিযোগ বহু পুরোনো। তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে বাজারে চাল সরবরাহ করা হয়। সরকারি চাপ বেশি থাকলে চালের দাম স্থিতিশীল থাকে, অন্যথায় ইচ্ছেমতো চালের দাম বেড়েই চলে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয় কিছু কৌশল। এক্ষেত্রে প্রথমে ধান সংগ্রহ করে দীর্ঘদিন মজুদ করে রাখা হয়, তারপর সংকট তৈরি হলে বাজারে ধান থেকে চাল করে মিল মালিকদের ইচ্ছেমতো মূল্য বেঁধে ছাড়া হয়। এমনটি প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসছে। এ ছাড়া সারা বছর উৎপাদিত ফসল, সবজির বিপণনে ফড়িয়া কিংবা মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবও এড়িয়ে যাওয়ার নয়।

আমরা দেখছি, সিন্ডিকেট গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান আকারে বড় ও ক্ষমতাবান। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে সহজে। এদের ঠেকানোর জন্য সরকারকে কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। সরকার যদি বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে পারে তাহলে এদের দৌরাত্ম্য কমানো সম্ভব। বাজার মনিটরিং কিংবা অভিযান পরিচালনা করে এসব সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। বিগত সরকারের আমলে সিন্ডিকেট তেলের বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। সিন্ডিকেটে কারা থাকে তা সবার জানা। আসলে সিন্ডিকেট বলতে কী বোঝায়? ‘সিন্ডিকেট হলো ব্যক্তি, কোম্পানি, করপোরেশন বা সংস্থাগুলোর একটি সুসংগঠিত গোষ্ঠী যা কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসা লেনদেন করার জন্য, একটি ভাগ করা স্বার্থ অনুসরণ বা প্রচার করার জন্য গঠিত হয়।’ ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালককে সদস্য সচিব করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক/প্রতিনিধি, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা/প্রতিনিধি, মৎস্য কর্মকর্তা/প্রতিনিধি, কৃষি বিপণন কর্মকর্তা/প্রতিনিধি, কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ও দুজন ছাত্র প্রতিনিধি। সর্বস্তরের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স আন্তরিকতা নিয়ে কাজ শুরু করলে সফলতা আসবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু যথাযথভাবে কাজ হচ্ছে কি না তাও দেখতে হবে, মানে নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের ওপর বাজার সিন্ডিকেটের নানা ফন্দিফিকির বন্ধ হলে  সাধারণের স্বস্তি ও শান্তি ফিরবে। 

মানুষ যদি সাধ্যের মধ্যে তার দ্রব্যসামগ্রী কিনতে পারে তাহলে স্বস্তি না ফেরার কারণ নেই। রমজান ঘিরে বাজার যাতে ঠিক থাকে, সে ব্যাপারে সরকার মনোযোগী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অতীতে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও রমজানে পণ্যের দাম বেড়ে যেত। তখনও দোষ দেওয়া হতো সিন্ডিকেটকে। আমাদের প্রশ্ন, এখন যদি সিন্ডিকেট বন্ধ না হয়, তবে কবে হবে? সেইসঙ্গে রমজান উপলক্ষে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, বাজারে সেগুলোর জোগানও বাড়াতে হবে। দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেছে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও অর্থ পাচার। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারও শক্তিশালী করা জরুরি। বিশ্বের বাণিজ্যিক ব্যবস্থা রাজনীতিকরণ হচ্ছে। সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার জন্য বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত পর্যন্ত প্রতিটি দেশের সঙ্গে আলাদা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কে প্রবেশ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, এটি অবশ্যই একটি খুব আকর্ষণীয় বাজার। যারা বাংলাদেশে এফডিআই নিয়ে এসেছে তারাও সে বাজারকে লক্ষ করে এসেছে। তাই এ বাজার পর্যাপ্তভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কি না, কোনো গুণগত উন্নতি করা যেতে পারে কি না এ বিষয়েও ভাবতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে পরিপক্ব হওয়ার পর উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানিতে পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের সম্ভাবনা তখনই আমরা ছুঁতে পারব, যখন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের মধ্যস্বত্বভোগী, সিন্ডিকেটের কালো ছায়া সরবে। পাশাপাশি বাজারে সরবরাহব্যবস্থা এমনভাবে গড়তে হবে যেন উৎপাদক ও বিক্রেতার মাঝে কোনো স্তর না থাকে।

  • অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা