× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ফলাফলের ভুল বিশ্লেষণ ও বিষণ্নতার ছায়া

আমিরুল আবেদিন

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০২:০২ এএম

আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:৫২ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

এসএসসি ও এইচএসসিতে এখন জিপিএ-৫-এর নিচে পেলে কেউ খুশি হয় না। জিপিএ-৫ না পেলে তাদের মধ্যে বিষণ্নতা যেন জেঁকে বসে। পরীক্ষার ফল তাদের কাছে আত্মসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি? পরীক্ষা মানে কী? পরীক্ষা মানে শিক্ষাজীবনে ধাপ ডিঙানোর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যম। একজন শিক্ষার্থী বয়সের ধাপে ধাপে কীভাবে এবং কী শিখেছে, তা প্রতিযোগিতার আদলে যাচাই করার জন্যই পরীক্ষা নেওয়া হয়। অনেকে অবশ্য পরীক্ষার বিপক্ষে অবস্থান করেন, কারণ তারা মনে করেন এতে একজন শিক্ষার্থীর মেধা পুরোপুরি যাচাই করা যায় না। তবে এমন ধারণাও ঠিক নয়। পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে অবশ্যই। একজন শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যখন ভালো ফল করে তখন ভালো ফলের আনন্দ তাকে পরবর্তী ধাপে উন্নতির উৎসাহ দিয়ে থাকে। অথচ আমরা দিন দিন শিক্ষার্থীদের সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছি। পরীক্ষার একটি বিশেষ দিক হলো সবচেয়ে কঠিন বাধা যে উতরাতে পারবে তাকে সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া হবে। আবার সেই শিক্ষার্থীও পরবর্তী ধাপে এই উৎসাহ নিয়ে যাবে, যত কঠিন পাঠ্যক্রমই হোক না কেন, পরিশ্রমের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন সম্ভব হবে। 

ফলাফলের স্বীকৃতির মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর মাঝে আত্মবিশ্বাস, গর্ব, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি বোধ জন্মায়। এই বোধগুলো ভবিষ্যতে আরও ভালো করার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এক সময় যারা বোর্ডে স্ট্যান্ড করত তাদের ছবি, তাদের বাবা-মায়ের ছবি, স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষকদের ছবি ছাপা হতো পত্র-পত্রিকায় এবং তাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতো। এমন নজিরও আছে। পত্রিকায় আলাদা করে তাদের নাম ও বৃত্তান্ত ছাপা হতো। কিছুদিনের জন্য ঘরে-বাইরে তারা আলোচনার কেন্দ্রে থাকার একটি ইতিবাচক দিক নিশ্চয় আছে। কারণ এই যে ভালো ফলাফলের সংস্কৃতি, তা অনেক শিক্ষার্থীকেই অনুপ্রাণিত করত। কয়েক দিনের জন্য সবার আলোচনার কেন্দ্রে আসার মাধ্যমে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া তখন থেকেই শুরু হতো। প্রতিটি রাষ্ট্রই এমন সূর্য সন্তান প্রত্যাশা করে। তাই পরীক্ষা প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। 

আগে চার বোর্ডে স্ট্যান্ড যারা করত তাদেরকে কোথায় আছে খুঁজলেই বোঝা যাবে তাদের অধিকাংশই জীবনে সফল হয়েছে। শুধু তাই নয়। কে কোন বিষয়ে স্টার মার্কস, লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগ পেয়েছে ইত্যাদি বিষয় এখনও অনেকের আড্ডার আসরে শোনা যায়। তবে এখন এসএসসি কিংবা এইচএসসিতে বোর্ডে স্ট্যান্ড করলেও শিক্ষার্থীরা আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারে না। কারণ তাদের কাছে পরীক্ষা আত্মবিশ^াস অর্জনের প্রক্রিয়া নয়। পরের ধাপে প্রবেশের সুযোগ। এসএসসিতে ভালো ফলাফল করার পেছনে এইচএসসির একটি সম্পর্ক আছে। এই দুটি পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বহু আগ থেকেই তারা কীভাবে এখানে আসবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। তাই পরীক্ষার ফল তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

আগে যারা সেকেন্ড ডিভিশনও পেত তাদেরও মুখ উজ্জ্বলই দেখা যেত। অনেকেই এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েও জীবনে সফল। হঠাৎ করে জিপিএ সিস্টেম চালু করা হলো আর ওইসব এখন রূপকথার গল্পের মতো হয়ে গেল। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মুখ থেকে এসব গল্প শুনে তা অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্বাস করতে পারে না। অনেকে মনে করে, হয়তো সে সময় এত প্রতিযোগিতা ছিল না। কথাটির সঙ্গে একমত হওয়ার অবকাশ নেই দুটো কারণে। প্রথমত, সে সময়ের শিক্ষা অবকাঠামো উন্নত ছিল না। সে সময় লেখাপড়া যদি সহজ হয়েও থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল সীমিত। এখন দেশের প্রতিটি প্রান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষই শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। এ কথা সত্য, শিক্ষা অবকাঠামোর নানাবিধ সমস্যার কারণে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এও সত্য, শিক্ষায় সবার অংশগ্রহণের বিষয়টি আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা নয়। দ্বিতীয়ত, তখন সুযোগ-সুবিধারও অভাব ছিল। এখন শিক্ষার্থীরা অনলাইন ঘেটে, গাইড বই পড়ে, টিউশনে গিয়ে অথবা বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে দ্রুত পাঠক্রম শেষ করতে পারে। আগে এত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীকে নিজের কৌতূহল এবং একাকি সমাধানের দিকেই বেশি জোর দিতে হতো। ফলে তখন অনেকেই আত্মনির্ভর হতে পেরেছেন যা এখনকার প্রজন্মে তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না। 

নতুন সিস্টেম চালুর পর লেখাপড়ার মান কি আগের চেয়ে বেড়েছে? না, তা যে হয়নি আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অনেকেই শিক্ষাব্যবস্থার মান বিচার করতে গিয়ে উন্নত বিশ্বে কোনো কোনো দেশের চিত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন। এটিও একটি ভুল প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে কিংবা উন্নত অনেক দেশেও পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। সেখানেও শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। তাই তাদের পাঠ্যক্রম ও পাঠদান প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে তুলনা করা ভুল। ওইসব দেশে শিক্ষা অবকাঠামো, বরাদ্দ, আর্থিক অবস্থা, সুযোগ-সুবিধা আমাদের পক্ষে এখনই দেওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাজাতে হবে। এমন নয় যে নতুন পদ্ধতি বাদ দিয়ে আমরা আগের প্রক্রিয়ায় ফিরে গেলে আবার অনেক প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী পাব। বরং নতুন পদ্ধতিকে কীভাবে যান্ত্রিকীকরণ থেকে মুক্ত করব তা ভাবতে হবে। উন্নত বিশ^ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সারা বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় পাঠ্যক্রম বাস্তবিক ও ব্যবহারমুখী করার লক্ষ্যে। ঠিক এজন্যই নিজ সামর্থ্য বিবেচনা করেই পরিকল্পনা সাজাতে হবে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণার মতো বিভাগ উন্নত বিশ্বে শিক্ষা অবকাঠামো ও পরিকল্পনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে শিক্ষা পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে সংযুক্ত করা হয় না। 

শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিকল্পনায় আমাদের সুযোগের অভাব রয়েছে এমন আলোচনা প্রায়ই শোনা যায়। অথচ আমরা ভুলে যাই, দেশে এ বিষয়ে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে এমন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সুবিধা নিয়ে গবেষণার জন্যই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ‘যোগাযোগ বৈকল্য’ নামক বিভাগ চালু করা হয়। সে সময় অনেকেই ভেবেছিলেন এবার হয়তো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে এমন শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। কারণ বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণা বরাদ্দ নেই। এমনকি আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলে তাতে গবেষণার মনোভাব তাদের গড়ে ওঠে না। খোদ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে বুঝতে পারে না সে কোন বিষয়ে পড়বে। তার চিন্তা ভর্তি পরীক্ষায় কোন ইউনিটে যোগ দেবে তা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা সাহায্য নামে অনেক গ্রুপ পাওয়া যাবে। সেখানে শিক্ষার্থীরা একই প্রশ্ন বারবার করে, কোন বিষয়ে পড়লে তারা চাকরি পাবে। কত বেতন পাওয়া যাবে? এমনটা কেন হচ্ছে? কারণ প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করার সময় তারা কয়েক বছর আগের পরিকল্পনা মাথায় রেখে লেখাপড়া করছে। 

আমরা জানি, ভালোমন্দের মিশ্রণ থেকে ভালোদের আলাদা করার ব্যবস্থা-প্রক্রিয়া যত ভালো এবং যে দেশ সেই ভালোদের যত্ন করে আরও ভালো করার ব্যবস্থা করতে পারে সেই দেশে তত বেশি ভালো মানুষ তৈরি হয়। যে সমাজে ভালো এবং মন্দ সকলের একইভাবে সেই সমাজে ভালো মানুষ তৈরি হবে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরীক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য অনেকটা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। তার মধ্যে উচ্চলাফ সবচেয়ে জনপ্রিয়। সেরা খেলোয়াড় নির্ধারণের জন্য উচ্চ লাফের বারকে ধীরে ধীরে ওপরে ওঠাতে থাকে আর যে সর্বোচ্চ উচ্চতার বার অতিক্রম করতে পারে সেই প্রথম হয়। পরীক্ষা অনেকটা এরকমই হয়। পরীক্ষার প্রশ্নের মান এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন ব্যবস্থা যদি এমন হয়, পরীক্ষা দিলেই জিপিএ-৫ পাওয়া যায় তাহলে পরীক্ষার কি আদৌ কোনো দরকার আছে? সবাইকেই খুশি করা কিংবা কাউকে অখুশি না করাই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে এই পরীক্ষা সিস্টেমের কোনো অর্থ থাকে না।

২০০১ সালে যখন জিপিএ পদ্ধতি চালু হয় তখন সেই বছর মাত্র ৭৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ২০০২ সালে জিপিএ-৫ পায় মাত্র ৩২৭ জন আর ২০০৮ সালে পায় ৪১ হাজার ৯১৭ জন জিপিএ-৫! আর তা বেড়ে ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। কী বিস্ময়কর! অর্থাৎ মোট পরীক্ষার্থীর প্রায় ১৫ শতাংশ জিপিএ-৫ পেয়েছে। এবার ভাবুন বাকি ৮৫ শতাংশের অবস্থা। তারা কি খুশি? তাদের বাবা-মা কি খুশিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্তানের ভালো রেজাল্ট নিয়ে কিছু লিখেছে? আত্মীয়স্বজনদের জানাতে ফোন করেছেন এমন খবর পাওয়া যাবে? পৃথিবীর কোনো দেশে কি এরকম উদাহরণ খুঁজে পাবেন যেখানে জিপিএ-৫ না পেলে ফেল করার কষ্ট অনুভূত হয়? 

 

লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক





শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা