সবুজ বিপ্লব
দুলাল আচার্য, সাংবাদিক
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৮ পিএম
দুলাল আচার্য
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর লবণাক্ত জমি এখন সবুজাভ। বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইলসহ দেশের সমুদ্রোপকূল ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর অধিকাংশ সময় পতিত থাকা জমিতে এখন বছরজুড়ে শাকসবজি চাষ করছেন কৃষক। একসময় একফসলি এসব জমিতে কেবল আমনের চাষ হতো। কিন্তু কৃষকের চাষের অভিজ্ঞতা-কৌশল আর কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এখন সবুজে ঘেরা এসব অঞ্চল। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। কৃষকের মুখে প্রত্যাশার হাসি। এতে নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এসব কৃষিপণ্য যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরে। কৃষক এখন স্বপ্ন দেখছেন চাহিদাসম্পন্ন দেশগুলোতে রপ্তানিরও। বলা চলে কৃষক এ অঞ্চলে শাকসবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে রবি মৌসুমে লবণাক্ততার কারণে কোনো রবিশস্যই এসব অঞ্চলে উৎপাদন হতো না। ফাল্গুন-চৈত্রে জমিতে লবণের আবরণ জেগে উঠত। লবণাক্ততার কারণে ফসল পুড়ে যেত বিধায় কৃষক ওই জমি চাষাবাদ করতেন না। জানা যায়, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ জমির লবণাক্ততার মাত্রা থাকে ২-১০ ডিএস-মিটার। সবজি চাষের জন্য জমি তৈরির সময় ওপরের অংশের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি ওপরে চলে আসে। এভাবে লবণাক্ততার প্রভাব কমানো সম্ভব হয়েছে। তারা যে বেড তৈরি করছেন, তা সমতল থেকে সাড়ে ৩ ফুট উঁচু। ফলে সেখানে লবণাক্ততা ছড়াতে পারে না।
নানা পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হাটচালা গ্রামের মনোতোষ মণ্ডলের দেখানো পথ ধরে উপজেলার বহু কৃষক এখন কোটি টাকার সবজি উৎপাদন করছেন। অনেকটা না বুঝেই চাষ করার চেষ্টা করতেন মনোতোষ। পরে কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেন। সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগান। সবজি চাষের জন্য প্রচুর মিঠাপানি সেচের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখানকার ভূগর্ভের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণ। মিঠাপানির আধার পুকুরও কম। তবে সবজি চাষ লাভবান হওয়ায় কিছু মানুষ নিজের জমিতে ছোট ছোট পুকুর খনন করে সেচের অভাব ঘোচানোর চেষ্টা করেন। মনোতোষ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ শুরু করেন ২০১৪ সালে।
অবশ্য এর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে প্রথম কান্দিপদ্ধতিতে সবজির আবাদ শুরু করেন পটুয়াখালীর শাহাদাত হোসেন। তার দেখাদেখি লবণাক্ত জমিতে এখন বহু কৃষক সবজি আবাদ করছেন। গঠন করেছেন সওদাগরপাড়া আদর্শ কৃষি সমিতি। মূলত শীত মৌসুমে শিম, মরিচ, বেগুন আর বর্ষা মৌসুমে মরিচ, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, বরবটি ও লাউ বেশি আবাদ হয়। সে সফলতায় আজ চারদিকে গাঢ় সবুজ সবজি ক্ষেত। কয়েকশ নারীও কাজ করছেন এসব জমিতে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামের কৃষকও কান্দিপদ্ধতিতে ফসল আবাদ শুরু করছেন। তারা ২০১৮ সালে নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক সমিতি গঠন করেন; যার সদস্য গ্রামের প্রায় সব কৃষক।
খুলনার উপকূলীয় উপজেলার লবণাক্ত পতিত জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষে সফলতা এসেছে। ফলে উৎকৃষ্ট মানের তেলের চাহিদা পূরণের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (এসআরডিআই অঙ্গ)-এর আওতায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রে রবি মৌসুমে ডিবলিং পদ্ধতিতে সূর্যমুখী চাষের গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নভেম্বরের মাঝামাঝি আমন ধান কাটার পর ভেজা মাটিতে সূর্যমুখীর বীজ ডিবলিং পদ্ধতিতে বপন করা হয়েছে। এরপর চারা গাছের গোড়া বেঁধে সার প্রয়োগ করা হয়। গবেষণায় তিনটি জাত ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয়, বারি সূর্যমুখী-২, হাইসান-৩৩ এ তিনটি জাতের সবকটিতেই ফুল ও ফল ধরেছে। এগুলোর মধ্যে হাইসান-৩৩ জাতের ফলন ভালো হয়েছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এ জাতের সূর্যমুখী বীজ কাটা হয়। গবেষকরা বলছেন, সূর্যমুখী লবণসহিষ্ণু ফসল। ফলে লবণাক্ত এলাকায় সূর্যমুখী চাষের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি উৎকৃষ্ট তেলফসল হওয়ায় মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া সূর্যমুখী তেলের চাহিদা পূরণ হবে। এ প্রযুক্তি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে কৃষককে সূর্যমুখী চাষে উৎসাহী করা প্রয়োজন।
ইউটিউব দেখে একফসলি ২৮ শতক ধানের জমিতে পলিমালচ পদ্ধতিতে লাউ চাষ করে সাফল্য পেয়েছিলেন বাগেরহাটের তরুণ কৃষক প্রণব দাস। একটা সময় বাজারে তার দোকান ছিল। বিগত করোনার সময় লকডাউন চলাকালে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ইউটিউব দেখে লাউ চাষ শুরু করেন। এখানকার জমিও আমন চাষের পর সারা বছর পতিত পড়ে থাকত। লাউ চাষ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই ২০০ থেকে ২৫০টি করে লাউ সংগ্রহ করতে পারছেন। পরে কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় পলিমালচ পদ্ধতিতে বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করছেন। তার দেখাদেখি অনেকেই এ পদ্ধতিতে চাষ করে সফল হয়েছেন।
খুলনার দাকোপ উপজেলায় বিনা চাষে আলু, পেঁয়াজ ও রসুন ফলাচ্ছেন কৃষক। ধান কাটার পর পরিত্যক্ত জমিতে আলু রোপণ করছেন। বীজের চারপাশে জৈবসার ও খড় বা লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এটি বারি আলু-৭২ প্রজাতির। এ আলুর ফলনও ভালো। এ ছাড়া সর্জন বা নালা পদ্ধতিতে লাউ, পেঁপে, টমেটো, শসা, খিরা চাষ করে সফলতা পাচ্ছেন খুলনা অঞ্চলের কৃষক। খুলনা অঞ্চলে সবজি চাষের বিপ্লবে সহায়তা করা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ‘ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন’ প্রকল্প। তারা লবণাক্ততা ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় এমন ফসল চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করছে। বিভিন্ন দপ্তর, এনজিওও স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। এ অঞ্চলে এখনও বিপুল পরিমাণ পতিত জমি রয়েছে। জমিগুলো আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে পর্যায়ক্রমে কাজ করা দরকার।
২০১৪ সালে বিএআরআই (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) পটুয়াখালীর গবেষণা বিভাগ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও কৃষিতত্ত্ব বিভাগ দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত পতিত জমিতে বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেয়। প্রথমে উপজেলার বান্দ্রা বাজারসংলগ্ন সেকান্দারখালী গ্রামে ৩০ জন কৃষক নিয়ে একটি দল গঠন করে। ওই কৃষককে উৎসাহিত করে চাষাবাদ শুরু করে সরেজমিন বিভাগ। প্রথমে তেমন সফলতা না পেলেও হাল ছাড়েনি। পরে ২০১৫ সালে .৭ হেক্টর, ২০১৬ সালে ১ হেক্টর, ২০১৭ সালে ১.৫ হেক্টর ও ২০১৮ সালে ৩ হেক্টর এভাবে ক্রমান্বয়ে চাষাবাদ করে আসছে; যা আজকের ইতিহাস। দিনদিন এ প্রযুক্তির প্রসারতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাচ্ছেন সফলতা। কৃষকের বীজ, সার, আগাছা নিড়ানো, সেচ, কীটনাশক ও জমি চাষাবাদে সব প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে এ প্রকল্প। জমির আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য পলিথিন মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করে টমেটো চাষ ও পুকুরের মিঠাপানির সঙ্গে লবণপানি মিশ্রণ করে সূর্যমুখী ও ভুট্টা চাষ করেছে এ সরেজমিন গবেষণা বিভাগ। সে ধারাবাহিকতায় আজ অনেক দূর এগিয়েছে এ প্রচেষ্টা। কৃষিতে সাফল্য আসায় এখন আর গ্রামের বাসিন্দাদের বিকল্প কাজের কথা ভাবতে হয় না। কাজের সন্ধানে শহরে যাওয়া গ্রামের অনেকে এসে কৃষির হাল ধরেছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণও কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন। স্বাবলম্বী গ্রামের নারীরাও। কৃষকের এ উদ্যোগ জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও ঝুঁকি হ্রাসের অসাধারণ দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এখনও কৃষির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাতও কৃষি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে এটি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্যনিরাপত্তায় এ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে সর্বদা ভঙ্গুর অর্থনীতি বলে ভর্ৎসনা করত পশ্চিমা বিশ্ব। কৃষিনির্ভরতার কারণেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে যুক্ত লবণাক্ত পতিত জমির আবাদের সাফল্যও। এটা আমাদের কৃষি অর্থনীতির জন্য বড় অর্জন। আসলে লবণাক্ত জমিতে আজকের যে সাফল্য তা অসাধ্য সাধনের নামান্তর। এ সাফল্যের পরিধি যত বিস্তৃত হবে ততই অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তাই এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।