সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩২ এএম
পুলিশের পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযানের মধ্যেও রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ যেভাবে বাড়ছে তাতে মানুষের উদ্বেগ ক্রমে বাড়ছে। এসব ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এমনকি ডাকাতি করতে গিয়ে গুলি ছুড়ে ভুক্তভোগীকে আহত করার ঘটনা সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটেছে। পাশাপাশি চলছে টার্গেট কিলিং, দখল আর ঘোষণা দিয়ে চাঁদাবাজি। নিরাপত্তা নিয়ে এখন সাধারণ মানুষ অসহায়। ধর্ষণের প্রতিবাদে রবিবার আসাদগেটে মিরপুর সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সমাবেশ-মিছিল করেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ দেশজুড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। ভুক্তভোগীরা মনে করে, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। পুলিশের তৎপরতা ঘাটতির সুযোগ নিয়ে পথেঘাটে, পাড়ামহল্লায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শুধু রাতে নয়, দিনদুপুরেও মানুষকে কুপিয়ে জখম করে সর্বস্ব নিয়ে যাচ্ছে। আইজিপি বাহারুল আলম ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা স্বীকার করেছেন। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, আনসার এমনকি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীও মাঠে কাজ করছে। কিন্তু অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোখা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য সবকিছুর দায় পতিত আওয়ামী লীগের দোসরদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। তবে পরিস্থিতি নিয়ে এটা তার আত্মরক্ষা না ব্যর্থতা সে প্রশ্ন রাখাই যায়। ২৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা ভয়ংকর’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ ভয়াবহ চিত্র। অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে ছয় মাসের বেশি সময়েও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটা নাজুক যে, তা সত্যি বিস্ময়!
প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, অভিযানে যৌথ বাহিনী সার্বিকভাবে সহযোগিতা করলেও পুলিশ নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারেনি ছয় মাসেও। এজন্য সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। অপরাধীর তালিকা এবং ক্রাইমজোন ভাগ করে সম্মিলিত অভিযান এখনও দৃশ্যমান নয়। ফলে অপরাধীরা নির্বিঘ্নে অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে। এ কথা সত্য, ৫ আগস্টের পর সারা দেশেই অভ্যুত্থানকারীদের আক্রোশে পড়ে পুলিশ। নানা আতঙ্কে পুলিশ বাহিনী সেই সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। এ নিষ্ক্রিয়তা কার্যত এখনও পুরোপুরি কাটেনি। দেশের থানাগুলো কোনোরকমে সচল করা গেলেও কার্যক্রম এখনও চলছে ঢিলেঢালা। এদিকে রাজধানীর রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বাড়ছে যানজট। যানজট এখন নিত্য বিড়ম্বনার নাম। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পার হলেও এখনও দেশে আইনশৃঙ্খলার দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা মনে করে, বিগত সরকারের পতনের পর বিভিন্ন থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, জেল পলাতক দাগি অপরাধীদের জামিন দেওয়া, পরে তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারাসহ নানা কারণে অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না। পুলিশে ব্যাপক রদবদল, গণহারে বরখাস্ত ও সংযুক্তির ঘটনাও সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারার কারণ বলে তাদের অভিমত। অন্যদিকে, পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ঘাড়ে গণহত্যার অভিযোগ থাকায়, মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ আগের মতো সক্রিয় হতে পারছে না।
গত ছয় মাসের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে ডাকাতির ৩৭৩, ছিনতাইয়ের ৮৯৫, হত্যার ২ হাজার ৩৫৭, সহিংসতার ১০৪, অপহরণের ৪৬৬, নারী নির্যাতনের ১০ হাজার ৩ ও চুরির ৬ হাজার ২৮৮টি মামলা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জানুয়ারিতে ৭১টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৭১টি। গত মাসে সারা দেশে ২৩১ জন খুন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা রেঞ্জে, ৭৬টি। দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রামে ৫১টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৪০টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা রেঞ্জে। জানুয়ারিতে ১০৫টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে ৩৪ ঘটনায়। পরিসংখ্যানটিই বলে দেয় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা কতটা ভয়ংকর। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ তারা ধরে রাখতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন এখনও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না, এ প্রশ্ন নাগরিকের। এ কথা ঠিক, আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ যা করেছে এবং আন্দোলন সফল হওয়ার পর এ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তাতে পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। লক্ষ করার বিষয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় পেশাদার অপরাধীরাও সক্রিয় হয়ে মাঠে নেমেছে। তাই পুলিশের এমন নিষ্ক্রিয়তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, কাম্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মানুষের জানমাল পড়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। শিগগির উন্নতি না ঘটাতে পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। আমরা সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাই। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে সে দায় সরকারকে নিতে হবে।