শিক্ষা
শেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:২৮ এএম
শেলী সেনগুপ্তা
‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ এ যৌক্তিক বাক্যটা সামনে রেখে বলতে পারি, একটা বিশাল অট্টালিকা দাঁড় করানোর জন্য যেমন মজবুত ভিত্তি দরকার, একটা বৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য যেমন দরকার অসংখ্য শেকড়-বাকর, তেমন একজন মানুষকে সঠিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। আর এ শিক্ষা অর্জন করার জন্য যেতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
প্রাচীনকালে শিশুরা শিক্ষার জন্য গুরুগৃহে যেত এবং সেখানেই জীবনের সকল প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করত। সেখানেই তাদের সামগ্রিক বিকাশ ঘটত। সেটি ছিল সে সময়ের চাহিদা।
তবে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গুরুগৃহ পরিণত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। একটি নির্দিষ্ট বয়সে শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় এবং সেখানেই তাদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, একই সঙ্গে বিকাশ ঘটে মানসিক স্বাস্থ্যের। তবে দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব একেবারেই দেওয়া হয় না, অথচ এটি খুব বেশি জরুরি। এজন্য শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গিয়েও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগী হতে হবে। কারণ, দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানবিক বিকাশের অন্যতম ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান মানসিক স্বাস্থ্য।
বৈশ্বিক নানা সমস্যার কারণে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা এবং মানসিক বৈকল্যের প্রাবল্য দেখা দিয়েছে। দুঃখজনকভাবে এর প্রধান শিকার কিশোর-কিশোরীরা এবং এর প্রভাবও হয় দীর্ঘমেয়াদি; এমনকি জীবনব্যাপী। এসব সমস্যা সব সময় জাতীয় উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে। বর্তমানে আমরা এ ধরনের সমস্যার মধ্যে আছি, কারণ আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতার অভাব দেখা দিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যে শরীরবৃত্তীয় যোগাযোগ রয়েছে তা রীতিমতো অবহেলিত। আমাদের মনে রাখা দরকার, মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থীরা তার সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে সহজেই সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। তাছাড়া শিক্ষার্থীর মানসিক সুস্থতা সমাজের জন্য অপরিহার্য। কারণ দিনশেষে বিদ্যালয়ের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে তারা বৃহত্তর বলয়ে মিশে যাবে, যাওয়ার সময় যেন সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে সুস্থ মানসিকতা এবং সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিছু আচরণ।
প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য দরকার অপরিমেয় আত্মবিশ্বাস। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ শিক্ষার্থীরা নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে, পারে যেকোনো কঠিন অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করে নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং সমাজে শিক্ষার্থীর মানসিক সুস্থতায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
কৈশোর বা তারুণ্য মানব জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ সময় ছেলেরা বাবা হওয়ার এবং মেয়েরা মা হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মনোজাগতিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ সময় কেউ অনেক কথায় কিছু মনে করে না, আবার কখনও অল্প কথায় রেগে ওঠে। যেহেতু সময়টি তাদের মানসিক বিকাশের, তাই বিষয়টির দিকে গভীরভাবে খেয়াল রাখা দরকার। বাবা, মা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সবাইকে কিশোর-কিশোরীদের মনোবিকাশে যত্নশীল হতে হবে। শৈশব থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে একজন মানুষ সফল ও সুখী জীবনযাপন করার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলিত, শিক্ষকরা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না। কখনও কখনও বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষকরা জানেনও না। মানসিক স্বাস্থ্যের কথা আলোচনা করলে অনেকেই এটিকে মানসিক রোগ মনে করে, এবং লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয়। আরও দুঃখের বিষয় হলো, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো মানসিক বিশেষজ্ঞ নেই, যার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায় বা শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমস্যা বিশদভাবে বর্ণনা করতে পারে এবং যথোপযুক্ত সমাধান পেতে পারে।
অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোয় পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় খুব বেশি। মানোন্নয়নের জন্য পরীক্ষাকেই একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে দেখা হয়। অনেক বেশি পরীক্ষা নেওয়ার প্রবণতা কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয়ভীতি জাগে, যা ধীরে ধীরে তাকে বিষণ্নতার দিকে নিয়ে যায়। শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে বিদ্যালয়বিমুখ। তাই সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার।
শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। কারণ, সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকের মধ্যেই অসচেতনতা আছে। বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই।
এ বয়সে নানা বিষয় নিয়ে পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ সময় কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয় এবং কারণে অকারণে রেগে ওঠে। সেগুলো পরিবার মেনে নিতে চায় না। পড়াশোনা, বন্ধু নির্বাচন, হাতখরচ, নির্দিষ্ট রুটিন মেনে না চলা, জীবনের লক্ষ্য নির্বাচন ইত্যাদি কারণে পরিবারের সঙ্গে নানা ধরনের সমস্যা শুরু হয়। সব সমস্যার মতো এ সমস্যারও সমাধান আছে। এজন্য দরকার আলোচনা এবং খুব কঠিন হয়ে গেলে দরকার মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় উন্নয়নের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এর জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত একজন হলেও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া উচিত।
শিক্ষাজীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চর্চা, ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটারবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি, এমনকি ক্যারিয়ারবিষয়ক দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিবর্তনের বিষয়টিও ভাবা দরকার।
এখনও অনেক বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়, যা শুধু নিষ্ঠুর ও অমানবিকই নয়, এটি শিক্ষার্থীর মনোবিকাশে বাধার সৃষ্টিও করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধিক পরিমাণে পরীক্ষা ও পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক চাপ, অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি কারণেও বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।
খেয়াল রাখতে হবে যেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা ঘরে কোনো প্রকার শারীরিক শাস্তি দেওয়া না হয়। মনে রাখা দরকার, মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার অভাবে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। এটি অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
মানসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দরকার শারীরিক বিকাশও। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শরীরচর্চায় উৎসাহী করে তুলতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে থাকা দরকার খেলার মাঠ। বিভিন্ন ধরনের খেলার সামগ্রী দিয়ে তাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।
সুস্থ ও সুন্দর মনের জন্য দরকার সুস্থ ও সুন্দর স্বাস্থ্য। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই প্রতিদিন পরিবার থেকে সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিদ্যালয়ে পুষ্টিকর টিফিনও দেওয়া যেতে পারে।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য দরকার সুন্দর পরিবেশ, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তা ছাড়া সবচেয়ে বেশি এবং সবার আগে দরকার প্রাণভরা ভালোবাসা। ভালোবাসলেই সংসারে অনেক অসম্ভব সম্ভব করা যায়। আর কিশোর-কিশোরীরা তো নরম মাটি, তাদের ভালোবেসে সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে সহায়তা করা সম্ভব।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য একটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং সমাজের যৌথ প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন করা সম্ভব। এজন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ প্রদান করতে হবে।