শিক্ষা
ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:০০ এএম
ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা
‘বই’ সম্পর্কিত দুটি শব্দ ‘পাঠ্য’ এবং ‘পাঠ’ নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। পাঠ্য শব্দটি ক্রিয়াবিশেষণ। যার অর্থ দাঁড়ায় অবশ্যই যা পাঠ করা উচিত। ‘পাঠ’ শব্দটি নিখাদ ক্রিয়া। পাঠক তার ইচ্ছেমতো কোনো গ্রন্থে মনোনিবেশ করলে যে কর্মটি ঘটে সেটা ‘পাঠ’ হিসেবে পরিগণিত হয়। ‘পাঠ’ শব্দে পাঠকের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু ‘পাঠ্য’ শব্দটির মধ্যে আবশ্যকতা রয়েছে। বয়স এবং শ্রেণিভেদে ‘পাঠ্য’ শব্দটির অর্থের দ্যোতনা রয়েছে। কোনো বই যখন কোনো শ্রেণিগোষ্ঠীর ‘জীবনযাপন’ সম্পর্কিত বিষয়াদি নির্দেশ করে তখন সে বই পাঠ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য অবশ্যকর্তব্য। এ পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে ‘পাঠ্যবই’ শব্দটির সঙ্গে শিক্ষার্থীর একটি নিবিড় সম্পর্ক প্রতিভাত হয়। শিক্ষার্থীর বয়স সাধারণভাবে যা বোঝায় তা হলো, বিদ্যালয়ে গমনযোগ্য (ছয় বছরÑ সরকারিভাবে ঘোষিত) শিশু-কিশোর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নযোগ্য যুবকের বয়স। এ বয়স অবশ্য কালভেদে পরিবর্তনযোগ্য এবং কোনো নির্দিষ্ট বিদ্যালয়সাপেক্ষ নয়।
বই-ই শিক্ষার্থীর প্রধান উপকরণ। বিচিত্র লেখার সম্ভারের সমাবেশ থাকে বইয়ে। শিশুর মানসিক বিকাশ, বুদ্ধির লালন, মেধার স্ফুরণ ইত্যাদি মানসম্মত (বয়সোপযোগী) বইয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। যেদিন মানুষ শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেছে ‘বই’য়ের প্রাসঙ্গিকতা এসেছে সেদিন থেকেই। আরবি ওহি থেকে বহি এবং বহি থেকে বই। এর সমার্থক শব্দ গ্রন্থ, পুস্তক ইত্যাদি। বই রচনার প্রথম তারিখ কোনটি তা ঠিক করে বলা মুশকিল। প্রাচীনকালে মিসরের নীলনদের তীরে জন্ম নেওয়া প্যাপিরাস গাছের বাকল দিয়ে তৈরি কাগজে প্রথম বর্ণভিত্তিক বই লেখা শুরু হয়। ধারণা করা হয়, মিসরের প্রথম ডাইনেস্টি রাজা নেফারতিতি কাইকেই (খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে)-এর আমলে সর্বপ্রথম বই রচিত হয়। ইতিহাসবিদ হিরোডোটাসের মতানুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব দশম অথবা নবম শতাব্দীতে মিসর থেকে প্যাপিরাস গ্রিসে রপ্তানি হয় এবং এখানে বই রচিত হয়। ‘কাল’ যখনই হোক গ্রন্থ রচনার মৌল উদ্দেশ্য সমকালীন ছিল, চেতনাকে বিশ্বকালীন করা। মানুষ তার পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে আহরিত জ্ঞান এবং জ্ঞানচর্চায় সঞ্চয়িত বোধ লেখার মাধ্যমে প্রকাশ এবং সংরক্ষণ করে তাকে সর্বব্যাপী করতে উদ্গ্রীব। ফলে বই রচনা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের একটি সহজাত সাধনা, অভিজ্ঞান।
গ্রন্থ রচনার প্রাথমিককালে সাহিত্য ছিল এর প্রধান উপজীব্য। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ অধ্যাত্ম সাধনার সংগীত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান মধ্যযুগে রচিত ইত্যাদি কাব্য নিখাদ সাহিত্য। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, পৃথিবীর সব ভাষারই প্রাচীন নিদর্শনাদি কাব্যনির্ভর। এসব গ্রন্থের পাঠক ছিল কম। শ্রোতার সংখ্যা ছিল বেশি। পুঁথি প্রকৃতির এসব বই সাধারণের পাঠের আওতায় আসেনি।
সময়ের বিবর্তনে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আসে। শুধু সাহিত্য, দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোর্তিবিদ্যা, সমরবিদ্যা ইত্যাদি নয়; এখন বিজ্ঞান, পরিবেশ, ভূগোল, অর্থনীতিসহ নানা বিষয় বিদ্যার্থীদের জ্ঞানলাভ লক্ষ্যে অধ্যয়ন করতে হয়। এসব বিষয়ে শিক্ষাদানে আবার প্রয়োজন ক্রমোশৃঙ্খল পদ্ধতি। শিশু শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিন্যাসে পাঠ্যবইয়ে ভিন্নতা রাখা জরুরি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যবই প্রণয়ন, মুদ্রণ, বিতরণ ইত্যাদি বিষয় পরিচালনা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
অবিভক্ত ভারতের পূর্ববাংলার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে ৩৮ সদস্যবিশিষ্ট ইস্ট বেঙ্গল স্কুল কমিটি গঠন করা হয়। দেশবিভাগের পর ১৯৫৪ সালে এর নামকরণ হয় ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্স্টবুক বোর্ড। স্বাধীনতার পর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও পুস্তক রচনার লক্ষ্যে তিন সদস্যবিশিষ্ট ন্যাশনাল কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট কমিটি (এনসিডিসি) গঠন করা হয়। পরে ১৯৮৩ সালে ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি) গঠন করা হয়। বর্তমানে এনসিটিবি প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ সব আবশ্যিক বই রচনা করে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করে। শুধু পাঠ্যসূচি বা পাঠ্যক্রম নয়, এনসিটিবি বিষয়ভিত্তিক শ্রেণিকার্যক্রমেরও নির্দেশনা দেয়। অর্থাৎ শিক্ষাকার্যক্রমের সিংহভাগ নীতিনির্ধারণ এ সংস্থাটি গ্রহণ করে থাকে।
বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে পাঠ্যবইয়ের ছক মোতাবেক পাঠদান করা হয়। দেশের সবকটি জেলার শহরে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে এ পদ্ধতিতে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। পরিতাপের বিষয় এনসিটিবির এ বিশাল কর্মযজ্ঞের বাস্তবানুগ প্রয়োগ শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছে কি না সন্দেহের অবকাশ আছে। বর্তমানে শিক্ষালাভের মৌলিক স্তরগুলো অপসৃত হচ্ছে ফলভিত্তিক পড়াশোনার নিমিত্ত। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ভালো ফল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অভিভাবকমণ্ডলীরও প্রত্যাশা সন্তান পড়াশোনা শিখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার অথবা বড় চাকুরে হবে। মানে বিত্তশালী হবেÑ এ চেতনা যেমন নেই শিক্ষার্থীদের (ব্যতিক্রম ছাড়া) মাঝে, তেমন নেই অভিভাবকদের মাঝে। যে করে হোক ভালো ফলই (এ-প্লাস) সবার কাঙ্ক্ষিত। ফলাফল তৈরি হয় পরীক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে গত এক দশকের পরীক্ষা পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক ১০০ নম্বরের পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন এখন দুই ধরনের। প্রথম অংশ (৬০ নম্বরের) সৃজনশীল এবং দ্বিতীয় অংশ (৪০ নম্বরের) বহুনির্বাচনী। শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার বৃত্ত ছিন্ন করে বুদ্ধিভিত্তিক চেতনার সম্মিলনে প্রশ্নের উত্তর প্রদানের লক্ষ্যে সৃজনশীল পদ্ধতি (জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগমূলক, উচ্চতর দক্ষতা) প্রণয়ন করা হয় এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকদের ব্যক্তিক আবেগের ক্ষেত্র সীমিত রাখার লক্ষ্যে বহুনির্বাচনী (৪০ নম্বর) প্রশ্নের অবতারণা করা হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন বা উত্তরপত্র পরীক্ষণে উপর্যুক্ত পদ্ধতির (সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী) মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই অধ্যয়নে অধিক মনোযোগী হওয়া। সৃজনশীল পদ্ধতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক উদ্দীপক তৈরি করা এবং এর আলোকে শিক্ষার্থীদের উত্তর তৈরির কৌশল আয়ত্ত করানো। এ পদ্ধতির আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো কমন না পড়া। অর্থাৎ কোনো পরীক্ষায় একবার যে উদ্দীপকটির আলোকে প্রশ্ন করা হলো সেটি আর কখনও উদ্ধৃত না করা। ফলে নিত্যনতুন উদ্দীপক তৈরি করা আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর প্রধান কাজ। তবে দেশের সব স্তরের শিক্ষকদের এ কাজটি করার সক্ষমতা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির বই ব্যবসায়ী সৃজনশীল পদ্ধতিকে সহজ, সরল এবং শতভাগ সফল ফলের নিশ্চয়তায় প্রণয়ন করছে গাইড বই। এতে এনসিটিবির বহুল গবেষণালব্ধ পদ্ধতি সীমায়িত হয়ে পড়ছে গাইড বইয়ে। আর শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীর স্কুলব্যাগ অথবা হাতে হাতে, শিক্ষকদের বুকশেলফে অথবা শ্রেণিকক্ষে শোভা পাচ্ছে গাইড বই। নির্মম হলেও এটাই সত্য।
জ্ঞানই শক্তি। জন্মের পর মানুষের ক্রমোন্নতির প্রতিটি স্তরে প্রয়োজন জ্ঞান। জান ধ্রুব নয়। স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী এর রকম ভিন্নতর হয়। জ্ঞান আহরণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো বই। শুধু কোনো বিশেষ উপলক্ষ বা লোকদেখানোর জন্য নয়, বইপাঠ হওয়া উচিত সাংবাৎসরিক। কোন গ্রন্থপাঠে মানুষের বিবেক কখন সমৃদ্ধ হবে বলা মুশকিল। বই পাঠ করতে হবে নির্মল আনন্দলাভের জন্য, জ্ঞানের প্রদীপশিখা প্রজ্বালনের জন্য। বইপাঠে যদি অবহেলা হয় অথবা পাঠ্যবই পড়ানোয় যদি বিঘ্ন ঘটে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। মানবসম্পদ মেধাহীন হলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমাদের দরকার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। শুধু আবেগ বা হুজুগ নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মেধার পরশ প্রয়োজন। জ্ঞানশালী এক দিনে হওয়া যায় না। এর জন্য আবশ্যক দীর্ঘ চর্চার। এ চর্চা হোক বইপাঠের মাধ্যমে। আলাপচারিতায়, সভা-সেমিনারে এমনকি প্রাত্যহিক কাজে বই আমাদের আলোকবর্তিকা হতে পারে। একটি বিদ্বৎসমাজ বইপাঠের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হলে স্কুলে তার সন্তানকে পাঠ্যবই দিয়ে পাঠাবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যবই নিয়ে ঢুকবেন। রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি সবার যৌথ প্রযোজনায় গড়ে উঠতে পারে বইপাঠ চক্র এবং পাঠ্যবই অধ্যয়নের শক্ত ভিত।