× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

নজর দিতে হবে অর্থনৈতিক কূটনীতিতেও

ড. সাহাব এনাম খান

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫৭ পিএম

ড. সাহাব এনাম খান

ড. সাহাব এনাম খান

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর সম্পন্ন করেছেন। এ সফরে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিস্তারিত এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সঙ্গতই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার যেকোনো ঘটনাই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বিশেষত প্রতিবেশী দেশের যেকোনো ধরনের চুক্তির সঙ্গে আমাদেরও কিছু স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। আবার অনেক সময় জড়িয়ে থাকে কিছু শঙ্কাও। কারণ, পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে দেশের মানুষের তো বটেই, কূটনৈতিক চ্যানেলের সঙ্গেও একধরনের শীতলতা দেখা যাচ্ছে। এমন সময়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাহী প্রধানের যৌথ সংবাদ সম্মেলন দেখে মনে হচ্ছে, মোদি এমন একটি চুক্তি করেছেন- যা ভারতের জন্য আসলে খুব লাভজনক না-ও হতে পারে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে তাদের বাণিজ্য ১৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ধরনের সংবাদ প্রথমে ইতিবাচক মনে হলেও বাস্তবে তা ভাবার সুযোগ অনেক কম। এ ক্ষেত্রে আমরা অতীত থেকে তথ্য নিতে পারি। অতীতে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে চীনের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্যের সময় যেভাবে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে এ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করবে। এর ফলে প্রায় ৫০ শতাংশ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে ভারতের পক্ষে। এখন পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করার মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যে যেভাবে শুল্ক আরোপ করে, ভারতও তেমনই শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর।

এখানে সমস্যার জায়গাটি কোথায়? সমস্যা হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-এর অধীনে ভারতকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো। এ সুবিধার মাধ্যমে ভারত তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বাড়তি সুবিধা পেত এবং তাদের লাভ অর্জনের সুযোগও ছিল। এ চুক্তির পর কার্যত ভারতের এ বিশেষ সুবিধা পাওয়ার পথ বন্ধ। এমনটি হলে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যের দাম বাড়বে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ভারতীয় বাজারে সস্তা হবে। এ পরিবর্তনের কারণে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমে যেতে পারে এবং ভারতের অর্থনীতিতে ক্ষতি হতে পারে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ভারত শুল্ক কমিয়ে মার্কিন পণ্য, বিশেষত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং তেল ও গ্যাসের আমদানি বাড়াবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসে। চুক্তি মোতাবেক ভারতকে আরও বেশি তেল ও গ্যাস আমদানি করতে হবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ভারত তার তেল আমদানির জন্য বরাবরই ইরাক, রাশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশটি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অনেকগুণ বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে ভারতের মোট তেল আমদানির ৪০ শতাংশই ছিল রাশিয়ার; এখনও তা প্রায় ৩৫ শতাংশে রয়েছে। ভারত রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল বাজারের দামের তুলনায় অনেক কম দামে কিনছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল আমদানি করলে একদিকে তা বাজার মূল্যে আসবে; অন্যদিকে শিপিং খরচ রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার জন্য ভারতের রিফাইনারিগুলোকে তাদের প্লান্টে অতিরিক্ত কাজ করতে হবে। এতে খরচ আরও বেড়ে যাবে। এসব কারণ তেলের দাম যথেষ্ট বাড়িয়ে দেবে। এটি ভারতের মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়াবে। কারণ, বেশিরভাগ পরিবহন খরচ ভারতের তেলের দামের ওপর নির্ভরশীল।

তাছাড়া এ সফরে ট্রাম্প জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে ১০ বছরের প্রতিরক্ষা অংশীদারির চুক্তি হয়েছে। যদিও এটি কৌশলগত অংশীদারি শক্তিশালী করার লক্ষ্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তবে মনে হচ্ছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের অধিকতর বাণিজ্য ভারসাম্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি সন্দেহ করতেই হয়। কারণ, ট্রাম্প সম্প্রতি তাদের অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দিয়েছেন। এ চুক্তিতে ভারতের মাটিতে প্রধান অস্ত্র সরঞ্জাম উৎপাদন করার শর্ত রয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রস্তুতকারকদের উচ্চ উৎপাদন খরচের কারণে এটি ভারতের জন্য খুব লাভজনক হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে যে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়, তার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিট্যাংক মিসাইল এবং এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার জেট। এসব অস্ত্র বর্তমানে রাশিয়া থেকে সস্তায় আনছে ভারত। কিন্তু এগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনলে খরচ পড়বে অনেক বেশি। এ চুক্তির ফলে ভারতের জন্য সব সময়ই নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। স্বল্পমেয়াদের ক্ষতি হিসেবে বলা যায়, এ চুক্তির ফলে ভারতের রুপি আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়বে যা ভারতের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ইতোমধ্যে ভারতের পার্লামেন্টে রুপির দর কমে যাওয়ার জন্য মোদির সমালোচনা করা হয়েছে। যদিও এসব অস্ত্রের আমদানি চীনকে মোকাবিলা করার কৌশল হিসেবে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু এগুলো আদতে পুরোনো প্রযুক্তির এবং চীনের আধুনিক ব্যবস্থার তুলনায় অনেক কম কার্যকর। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষের মতো জায়গায় সস্তা ব্যাটারিচালিত ড্রোন যুদ্ধে এসব অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

এ সফরের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, দুই দেশ ১৬ বছর আগে স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক চুক্তির বাস্তবায়ন করতে রাজি হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহ করবে। তবে চুল্লিগুলো পুরোনো ও ব্যয়বহুল বলে ভারতীয়রা ইতোমধ্যে নানা সমালোচনা করছেন। অনেকের মতে, চীন যখন চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের চুল্লি তৈরি করছে, তখন ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের চুল্লি আমদানি করবে। ২০৩৫ সালের পর ফিউশন পারমাণবিক প্রযুক্তিতে দ্রুত উন্নয়ন হবে। সুতরাং এ চুক্তি ভারতের জন্য তেমন লাভজনক হবে না। এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে।

মধ্যমেয়াদের কথা চিন্তা করলে বলা যায়, এ চুক্তির ফলে যদিও মার্কিন পণ্য (যেমন ইলেকট্রনিকস, পোশাক ও জুতা) সস্তা হতে পারে এবং ভারতীয় বাজারে তা প্রচুর পাওয়া যাবে, তবে বেশিরভাগ ভারতীয় নাগরিক (বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবার) ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সমস্যায় পড়বে। আর দীর্ঘমেয়াদে মোদির ‘আত্মনির্ভর ভারত’ উদ্যোগ হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ, ভারতীয় পণ্যগুলো মার্কিন সস্তা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এটি ভারতের সস্তা শ্রমের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাও নষ্ট করে দেবে। যদি ইউরোপও একই ধরনের ট্যারিফ নীতি গ্রহণ করে, তাহলে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা আরও খারাপ হতে পারে। তবে এ চুক্তির ফলে ভারত কিছু লাভও পেতে পারে। প্রথমত. যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দাম তুলনামূলকভাবে কম, যা পশ্চিম এশিয়ার গ্যাসের চেয়ে সস্তা। দ্বিতীয়ত. যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে ত্বহাউর রানার প্রত্যর্পণ অনুমোদন করেছে। এটি মোদির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জয় হতে পারে। কারণ, রানা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব লাভ ভারতের বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষতির তুলনায় খুবই কম। সে কারণে মোদিকে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যনীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে মোদি ও ট্রাম্পের বৈঠকে বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গটিও এসেছে। অনেকে মনে করেন, বৈঠকে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। বাস্তবে তা বলা যাবে কি না সন্দেহ। কারণ, ট্রাম্প এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেই ভূরাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। তবে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশের  প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতেই পারে। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টি আমাদের জন্য ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনোটিই ভাবার সুযোগ নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো কৌশলগত কিংবা অর্থনৈতিক কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। ভারতের সঙ্গে যেমনটি হয়েছে তা আমাদের সঙ্গে হলে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনীতি আরও স্থবির হয়ে পড়বে। এটি আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেলের জন্য একটি বড় উদাহরণ ভেবে অর্থনৈতিক কূটনীতি পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।

  • অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা