গণমাধ্যম
জাহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫২ পিএম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজ অনেক সহজ করে দিচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও দেবে। এটা অমোঘ সত্য কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন কিছু করে দেবে, যাতে মানুষের আর মাথা খাটানোর প্রয়োজনই হবে না তাহলে তিনি ভুল ভাবছেন। গণমাধ্যমের কাজগুলোর একটি বড় অংশ হচ্ছে মানুষের মাথা খাটানো। এই যেমন সংবাদ বিশ্লেষণ কিংবা বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন তৈরি করা। যদি এ রকম একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন তৈরিতে হাত দেওয়া হয়, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কতখানি পড়বে। নিঃসন্দেহে এ বিশ্লেষণ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করে দিতে পারবে না। এজন্য দরকার হবে গবেষণা ও সংবাদ বিশ্লেষণের জন্য নির্দিষ্ট সেক্টরে লব্ধ অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে অনুবাদ, লেখালেখির ফরম্যাট, ছবি সংযোজন, মেকআপ, এমনকি ফিচার রাইটিং কিংবা ভিডিও এডিটিং, মিউজিক কম্পোজিশন ও সাবটাইটেল সংযোজনের মতো কাজ সেরে দিতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এবার আমরা একনজরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গণমাধ্যমে কী ভূমিকা রাখছে তা মোটা দাগে দেখে নিতে পারি। অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন (ওসিআর) কে আপনি মেশিন লার্নিংয়ের একটি টুল বলা যায়। মেশিন লার্নিং আজকাল বেশ প্রচলিত টুল। এ টুল ব্যবহার করে অনেক কাজ সহজে করে ফেলা যায়। গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনে অনেক লেখালেখির প্রয়োজন পড়ে। কম্পিউটারে অনেক শব্দ টাইপ করতে হয়। এ কাজটা অনেক সহজ করে দিতে পারে স্মার্ট ওসিআর। হাতের লেখা পাতা, তা যে ভাষাতেই হোক না কেন নিমেষেই কম্পিউটার টাইপের ওয়ার্ড, পিডিএফ যেকোনো ফরম্যাটে রূপান্তর করে দিতে পারে এ টুল। এছাড়া অনুবাদ করে দিতে পারে। একটি ওসিআর ইঞ্জিন ইমেজটু বৈশ্বিক ভাষায় বহুমাত্রিক সমাধান এনে দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ইমেজ টু টেক্সট, পিডিএফ টু টেক্সট, টেক্সট টু ইমেজ, এমনকি ফটো টু ভিডিওসহ নানা সুবিধা। এ ছাড়া যেকোনো সিম্বল টু টেকস এবং টেকস টু সিম্বলসহ গ্রাফিকের মিনিং থেকে শুরু করে যেকোনো সিম্বলও বানিয়ে দিতে পারে এ টুল। গুগল ক্লাউড একটি সমন্বিত টুল। এটি শুধু আপনাকে স্টোরেজ সুবিধা দেবে না, বরং আরও নানান সুবিধা দেবে যাতে অনেক কঠিন, কষ্টসাধ্য ও সময়সাধ্য কাজ সহজ হয়ে যাবে। গুগল ক্লাউডের অনেক টুলসের কয়েকটির পরিচিতি-ট্রান্সসিলেশন: বৈশ্বিক ভাষা অনুবাদের জন্য।স্পিক টু টেক্স মুখে বলে টাইপ করার জন্য ব্যবহৃত।ন্যাচারাল লেঙ্গুয়েজ এপিআই ভাষাকে স্থানীয়, লোকজ ও প্রাকৃতিক রূপদানের জন্য এব্ং ভিডিও ইন্টিলিজেন্সি সাধারণ ভিডিওকে বহুমাত্রিক ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
সংবাদপত্রে মেকআপ করার জন্য এআইয়ের ব্যবহার রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে এ-জাতীয় বিভিন্ন টুল ব্যবহার করা হয়। এ টুলগুলো নান্দনিক সাজে সংবাদপত্রের পাতা সাজিয়ে দেবে। এর কয়েকটি যেমনÑইন্টার রেড জিএমবিএইচ : এটি জার্মানভিত্তিক একটি সলিউশন। এআইচালিত সংবাদপত্র ও ওয়েব পেপারের ডিজাইন করার জন্য নিভর্রযোগ্য একটি প্ল্যাটফর্ম। এটি সাবস্ক্রাইব করতে হয়। ইয়েসচেট, মেলে বিনা পয়সায়। সংবাদপত্র ও ওয়েব পেপারের ডিজাইন এ এআই টুল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাজিয়ে দেয়। এছাড়া মোবিরাইজ মূলত ওয়েব ডিজাইনের জন্য বিশেষায়িত। এটি ওয়েব নিউজ পোর্টালের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। তবে প্রিন্ট ভার্সনের সংবাদপত্রেও এটা কাজে লাগাতে পারেন।
সংবাদপত্রের লে-আউটের জন্য ফ্রিপিক জনপ্রিয় টুল। জাপির বিশেষত ওয়েবসাইট ডিজাইনের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে ওয়েবভিত্তিক পোর্টালেও ব্যবহার করা যেতে পারে। গণমাধ্যমের জন্য সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির জন্য নিউজ আর্টিকেল জেনারেটর বিভিন্ন নামে বিভিন্ন প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত কাঁচামাল হিসেবে সরবরাহ করলে নিউজ জেনারেটর কাঙ্ক্ষিত নিউজ বানিয়ে দেয়। এআই সুবিধাসংবলিত নিউজ আর্কাইভ সংবাদকর্মীদের অনেক কাজ সহজ করে দেয় ইন্টার্যাকটিভ নিউজ আর্কাইভ। প্রতিটি নিউজ আইটেম শ্রেণি-চরিত্র বিভাজন অনুযায়ী বিন্যাস করে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়ে যায়। আবার প্রয়োজনে খোঁজার সময় বিষয়বস্তু অথবা কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করলে কাঙ্ক্ষিত নিউজ খুঁজে পাওয়া যায়। ম্যানুয়ালি যে কাজটি করতে আপনার ৯০ দিন লেগে যেত, সেটা বড়জোর ৯০ সেকেন্ডে করে দেবে ইন্টার্যাকটিভ নিউজ আর্কাইভ।
কোনো বিষয়ে জানমত যাচাই পরিসংখ্যান পরিচালনার জন্য নিউজ কুইজ জেনারেটর খুবই উপযোগী। সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন ও উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ঠিক করে দিলে এ টুল লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মতামতের প্রতিফলন আপনাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতের মুঠোয় এনে দেবে। আজকাল পত্রিকাগুলোতে জনমত তুলে ধরার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তাদের জন্য এ টুল খুবই কার্যকর। এ এআই টুল আপনাকে ভিডিও দেখে দেখে স্ক্রিপ্ট বানানোর কষ্ট লাঘব করে দেবে। ভিডিও দেখে উপযুক্ত একটি ট্রান্সক্রিপ্ট বানিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে এ টুল। এআই ইমেজ জেনারেটর ঠিক স্ক্রিপ্ট জেনারেটরের উল্টো অর্থাৎ আপনার স্ক্রিপ্ট থাকলে প্রয়োজনীয় ইমেজ/ভিডিও বানানোর সক্ষমতা রাখে এ টুল। ইচ্ছা করলে আপনার তোলা স্টিল ইমেজ এ টুলের সাহায্যে ভিডিওতে রূপান্তর করা যায়।
আধুনিক তথ্য-প্রজন্মের পক্ষে ও বিপক্ষে রয়েছে অনেক যুক্তি। কালের যাত্রায় সংবাদমাধ্যমে প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটেছে, আর সে প্রবেশের মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমে নীরব বিপ্লব হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেমন গতি এসেছে তেমনি খবর পরিবেশনেও এসেছে বৈচিত্র্য। প্রযুক্তির এই অগ্রসরতার হাত ধরেই আসছে এইআই। যার ব্যবহার নিউজ প্রোডাকশনের মান, গতি ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অসৎ ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি মিথ্যা কিংবা অতিরঞ্জিত খবর, পক্ষপাতদুষ্টতা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের ঝুঁকি থাকবেই। এআই কর্তৃক জেনারেটকৃত ছবি ও ইনফোগ্রাফিক্স-ভিডিও কনটেন্টকেও প্রভাবিত করার আশঙ্কা থেকে যায়। যার ফলে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার লক্ষ ধরে রাখা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। যার ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্বেগের প্রধান কারণগুলো থাকছেই। কারণ, এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রোবট বা রোবটিক্স উৎপাদন বা উৎপাদিকতার প্রতীক হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবসময়ই সন্দেহের পাত্র। কারণ, যে বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিম, তার ওপর কি মানুষের আস্থা থাকবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ফটোসাংবাদিকের ফটো-ইমেজের ভেক্টর-রূপায়ণ কিংবা তথ্যসূচক বানানো এক জিনিস; কিন্তু অয়্যার সার্ভিস বা বার্তা সংস্থার সংবাদ কনটেন্ট প্রবাহের নতুন রূপায়ণ ও সত্যের কৃত্রিমিকরণ সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। উদ্বেগের কারণটাও এখানেই।
সবমিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি এবং সংবাদমাধ্যমে এআই-এর প্রয়োগের ভালো-মন্দ বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা চলছে, চলছে গবেষণা। তাতে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধাগুলো যেমন শনাক্ত হচ্ছে তেমনি এর অনিবার্য বিপদ ও অন্তরায়গুলোও সামনে আসছে। তবে এআই গণমাধ্যম শিল্পের জন্য যেমন ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম, তেমনি এর ক্ষতি করার ক্ষমতাও অনেক। তাই ক্ষতির দিকটিকে বিবেচনায় রেখেই উদ্বেগের প্রকাশ। সংবাদমাধ্যমের প্রধান বিষয় তার বিশ্বাসযোগ্যতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা করে যদি সংবাদমাধ্যম তার বিশ্বাসযোগ্যতায় হারায়, তবে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কাজ হারিয়ে পেশা থেকেও সরে যেতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা বলছেন এআই সারা বিশ্বে ম্যানুয়াল কাজ করার অবসান ঘটিয়ে একটা নতুন যুগের সূচনা করবে। গণমাধ্যমও এর বাইরে নয়। নতুন মানেই সম্ভাবনা। আর নতুন সম্ভাবনায় থাকে অসংখ্য প্রতিকূলতা। এ প্রতিকূলতার বাঁধ ভেঙে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো অনেকদূর এগিয়ে যাবে এ কথা মানতেই হবে। তবে মানুষের মানবিক বুদ্ধিমত্তা অতিক্রম করতে পারবে না কোনো দিন। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মানবিক বুদ্ধিমত্তা হাত ধরাধরি করে হাঁটলে এ থেকে মানুষ অনেক উপকার পাবে। তবে এজন্য অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। সেজন্য অপেক্ষা ও প্রস্তুতি দুটোই দরকার।