× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নারীর নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন

আফরিদা ইফরাত

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:৪৪ পিএম

আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:৫২ এএম

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

দেশে নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নারীর কাজের হার বেড়েছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়, রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব চোখে পড়ার মতো, কৃষিতে নারীর অবদান পুরুষের প্রায় কাছাকাছি। খেলার মাঠে নারী। সেখানেও তাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ক’দিন আগেই সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো গৌরব অর্জন করেছে তারা। ব্যবসা চালাচ্ছে নারী। প্রযুক্তি খাতেও বেড়েছে নারীর প্রবেশাধিকার। দেশে অসংখ্য নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তা নানাভাবে সফল হচ্ছেন। এত কিছুর মধ্যে সংসার সামলাচ্ছে নারী। দেশের সার্বিক এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে নারীর ভূমিকার কথাও গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে। গ্রাম বা শহর সবখানেই কাগজে-কলমে নারীর এগিয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মতো। আমরা এই এগিয়ে যাওয়াকে সাদরে বরণ করে নিয়েছি এ কথা সত্য। কিন্তু আমরা এখনও তাদের জন্য টেকসই উন্নয়ন এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি। 

আজকের নারী ঘরোয়া কাজের বাইরে নানাবিধ কাজের সঙ্গে জড়াচ্ছেন জোর কদমে। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশা যেমনÑপুলিশ, সেনাবাহিনী, উড়োজাহাজ ও গাড়ি চালনা, পর্বতারোহণ, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞান, ফুটবল, ক্রিকেট, রেফারি, গ্লাইডার, সার্ফার, মাছ ধরা, কৃষিকাজ করা, শ্রমিক ইত্যাদি সব ধরনের কাজে নারী এগিয়ে এসেছেন। এরপরও সিংহভাগ নারীকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে। তাদের অন্যের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। একক নারী, নারীর একক পরিবার এবং একক মাÑনারীর এই পরিচয়কে সমাজ করুণার চোখে দেখে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্রদৃষ্টি হানে। উন্নয়ন ও আধুনিকতার এই ডামাডোলের মধ্যেও নারীকে এক ধরনের ভয়ের পরিবেশে চলাফেরা করতে হয়। ঘরে-বাইরে বিশেষত গণপরিবহনে তাদের নিরাপত্তার অভাব নতুন কিছু নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর যতই অর্জন থাকুক, নিরাপত্তা ও অধিকারের মঞ্চে নারী কতটুকু পাচ্ছে? স্বাধীনতার উত্তরকালে দেশে নারীর নানা ক্ষেত্রে উন্নতি এবং অংশগ্রহণের পথ কিছুটা সুগম হলেও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেন স্থবির হয়ে আছি আমরা। এই এক জায়গায় গ্রামের একজন খেটে খাওয়া নিরক্ষর নারীও যা, শহুরে শিক্ষিত নারীও তা। সবসময়ই তাকে অন্যের আশ্রয়ে, প্রশ্রয়ে, শাসনে, শোষণে বাঁচতে হয়। বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে পড়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে অনেক নারী প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হতেই পারেন না।

নারী যতই সংগ্রাম করে এগিয়ে যাক না কেন, সমাজ তাকে যেন পেছন থেকে টেনে ধরে রাখতে চায়। ভারতের পুরোনো ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, ভারতবর্ষে পশ্চিমা আক্রমণের আগে (২৫০০ বছর আগে) নারী-পুরুষ সমঅধিকার ছিল। তখন ধর্ম ছিল শিক্ষা ও জ্ঞানের অংশ। পরে ধর্মকে করেছে রাজার দোসর বা হাতিয়ার, যার শুরু হয়েছে ইংল্যান্ড রোমান শাসনামলে। এত বছর পরে সেইসব আধুনিক দেশে নারীর একটা পরিচয় তৈরি হলেও উপমহাদেশে তা কাক্সিক্ষত মাত্রায় সম্ভব হয়নি। সমাজ নারীর অহংবোধ ও মর্যাদাবোধকে জাগ্রত হতে দেয় না অনেক ক্ষেত্রেই। এমনকি দেশে অবস্থানরত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সামাজিক কাঠামো দেখলে অবাক হতে হয়। এখনও অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমাজে নারীর কর্তৃত্ব রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে তাদের অংশগ্রহণ এবং নিজের ওপর আত্মবিশ^াস ধরে রাখার বিষয়টি যেন সেই সাক্ষ্যই দেয়। মোদ্দাকথা, আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি না হলে একজন নারীর পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও কঠিন। এই সুযোগ গ্রহণ করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষেরা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে অনেক কিছু অর্জন করেছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে গত ২/৩ দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার পরও এই সংখ্যাগত হার পুরুষের চেয়ে অনেক কম। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দেশের পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার কারণে অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখনও যথার্থ দৃষ্টি পাচ্ছে না। নারী তার সময়ের একটা বড় অংশ বাজারকেন্দ্রিক কাজের চেয়ে বাজারবহির্ভূত কাজে ব্যস্ত থাকে। যেহেতু তাকে ঘর সামলাতে হয়, তাই এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে যেন নারীর ওপর এমন দায়িত্ব আমরা বিবেচনা না করেই চাপিয়ে দিচ্ছি। আমরা বিনামূল্যের গৃহস্থালি কাজগুলোকেই অ-অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করছি। এই অস্বীকৃত এবং অদৃশ্য কাজগুলো শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুর যত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্ন নয়। এর সঙ্গে আছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ। সমস্যা হলো, এই সঙ্গে থাকা কাজগুলো যে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আমরা দেখেও দেখছি না। 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে অনেক কিছু অর্জন করেছেÑএ কথা অসত্য নয়। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে গত ২/৩ দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত গার্মেন্টস শিল্প নারীর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে যেখানে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে এসে তা হয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন দেশে ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই কাজগুলো কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন। অথচ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ একে মূল্য দেয় না। যেমনÑকরোনাকালীন গার্মেন্টস শিল্পে নারীকর্মী ছাঁটাইয়ের হার বেড়েছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, এই শিল্পে পুরুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এই অংশগ্রহণ বেড়েছে নারীকর্মী হ্রাস পাওয়ার কারণে। মহামারির সময় নারীকে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাকে ঘর সামলাতে হয়েছে এবং কর্মক্ষেত্রেও ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, করোনাকালীন নারীর ওপর নিপীড়ন বেড়েছিল। এ থেকে বোঝা যায়, কোনো সংকটকাল নারীর জন্য কতটা ভয়াবহ। 

বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে শুধু উপার্জনকারী হিসেবে নয়, বরং সংসারের মুখ্য উপার্জনকারী হিসেবে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। নারী ঘরের পুরোটা কাজ করছেন, বাইরেও উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু এরপরেও তাকে নিয়মিতভাবে নিপীড়িত হয়ে, বিচারহীন ও মর্যাদাহীন অবস্থার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এমনটা মোটেও আকাক্সিক্ষত নয়। কপ-২৭ সম্মেলনে নারীর অংশগ্রহণ এবং ভূমিকার বিষয় নিয়ে বিশ^ব্যাপী আলোচনা হচ্ছে। সারা বিশে^ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বিভিন্ন সম্মেলনের আলোচনা থেকে স্পষ্ট। বিশে^ অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। এই সময়ে নারী ঘর সামলাবে কীভাবে? ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ব্যয় সংকোচনের পথ নিতে হচ্ছে প্রত্যেককে। নারী যখন উদ্যোক্তা, ক্রীড়াবিদ, চাকরিজীবী, তখন তাকে ঘরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সবকিছু করতে হয়। নিজের খরচ থেকে কাটছাঁট করে তাকে ঘরে-বাইরের সামঞ্জস্য ধরে রাখতে হচ্ছে। আগের মতো সে বাড়ি ফেরার সময় রিক্সায় না চেপে গণপরিবহনে যাতায়াত করে। অনেক রাত হলেও অনেক সময় সে হেঁটে বাড়ি ফেরে। এমন সময় তার নিরাপত্তা জরুরি। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে নারী কোণঠাসা হয়ে পড়বে। উন্নয়ন টেকসই করতে হলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। দুর্ভিক্ষে ঘরে কোণঠাসা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ঘরেও নারী নিরাপদ নয়। এমন নয় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। নারীর স্বাবলম্বনে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যত আইন ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলেই নারী তার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উৎপাদনমুখী হওয়ার দিকে জোর দিয়েছেন। এমন সময়ে নারীও যেন অর্থনীতিতে তার পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে, সেজন্য তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। 


লেখক : সংবাদমাধ্যমকর্মী


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা