হাকিম আরিফ
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪৮ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৪৮ পিএম
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে আসছে। রাজধানী হিসেবে অর্ধশতাব্দীব্যাপী পরিচিতি পেয়ে এলেও ঢাকা কি প্রকৃত অর্থে একটি আন্তর্জাতিক শহর, বৈশ্বিক পরিসরে যাকে কসমোপলিটন শহর বলা হয়, হতে পেরেছে? এ বিষয়টি ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, বৈশ্বিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি, বহুভাষিক জনজাতির বসবাস ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ থেকে কোন দেশের রাজধানীর আন্তর্জাতিক মান হিসেবে আনা হয়, এ ক্ষেত্রে দ্বিভাষা বা বহুভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহারও একটি বিশেষ মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে থাকে।
ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রাজধানী হিসেবে পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্তের পরও ঢাকা কোনো অর্থেই আন্তর্জাতিক বা একটি কসমোপলিটন শহর হয়ে ওঠেনি। এর বহুবিধ কারণও রয়েছে। প্রথমত. বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বাংলাভাষীদের দ্বারা একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে, যেখানে মোট জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশের বেশি লোকের মাতৃভাষা বাংলা, এর রাজধানী ঢাকা শহরটি পরিপূর্ণভাবেই বাঙালিনির্ভর শহর। আর বাংলাদেশে যে ১.৫% অবাঙালি জনগোষ্ঠী ৪০টি মাতৃভাষায় কথা বলে তারা শিক্ষাদীক্ষা ও সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির দিক থেকে এতই প্রান্তবর্তী যে, এদের খুব কমসংখ্যকই ঐতিহাসিক কারণে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ ও সবিধা পেয়েছে। সে কারণে পাশের দেশসমূহের রাজধানী শহর, যেমন দিল্লি, ইসলামাবাদ বা কাঠমান্ডুর মতো ঢাকার আনাচকানাচে অথবা রাস্তা বা গলিতে বিভিন্ন মাতৃভাষার কথা ও কলরব অহরহ শোনা যায় না। ফলে ঢাকা শহরের মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপনে প্রতিদিন একই ভাষা, বাক্য বা ধ্বনিগত সুর তরঙ্গের চর্চা হয়।
দ্বিতীয়ত. রাজধানী ঢাকা শহরে এখন পর্যন্ত বড় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর স্থাপিত হয়নি। এমনকি এখানে কোনো আঞ্চলিক সংস্থারও ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় না। ফলে এ শহরে বাংলা ছাড়া ভিন্নভাষী মানুষের বসবাস ও আনাগোনা নিতান্তই কম। পাশাপাশি রাজধানী শহর হওয়ার কারণে যে স্বল্প কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলো এ শহরের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এগুলোতে কর্মরত ভিন্নভাষী মানুষের কর্মতৎপরতা শহরব্যাপী চোখে পড়ে না।
তৃতীয়ত. একটি শহর প্রকৃত অর্থে কসমোপলিটন হয়ে ওঠে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও অবস্থানের কারণে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন কসমোপলিটন শহরের ক্ষেত্রে তা প্রকৃত অর্থেই প্রযোজ্য। এ দুই মহাদেশের শহরগুলোয় বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের কারণে প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ লাভ করে যার অনেকেই ভবিষ্যতে স্থায়ী হিসেবে আবাস গাড়ে। ফলে এ শহরগুলো বহুভাষী কসমোপলিটন মহানগরে পরিণত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে ঢাকায় এখনও কোনো আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই; যেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীরা ভর্তির জন্য উৎসাহী হবে। তবে সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে কিছুটা অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের কারণে। বৈশ্বিক বিচারে এসব বিশ্ববিদ্যালয় খুব মানসম্মত না হলেও শুধু শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় আফ্রিকাসহ পাশের দেশের অনেক শিক্ষার্থী এখন ঢাকার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে আসেন। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে কিছু সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন ওআইসি প্রতিষ্ঠিত আইইউটি বা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করেছেন। ফলে রাজধানী ঢাকা শহরের ভাষিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে।
চতুর্থত. আশির দশকের আগ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা শহরে প্রচলিত অর্থে কোনো শিল্পায়ন ঘটেনি। তখন পাট এবং চামড়া এ দেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য হলেও এসব প্রতিষ্ঠানে সহসাই কোনো বিদেশি বা ভিন্নভাষী লোক কাজ করত না। কিন্তু আশির দশকের শেষে বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ব্যাপকহারে প্রতিষ্ঠালাভের সূত্র ধরে রাজধানী শহর ঢাকায় অসংখ্য আন্তর্জাতিক মানের পোশাক কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক বিদেশি দক্ষ কর্মী কাজ করতে শুরু করেন, যে ধারাটি এখনও চলমান রয়েছে। তবে ঢাকা শহরে বসবাসরত বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠীর তুলনায় এসব ভিনদেশি ভিন্নভাষী মানুষ চোখে না পড়লেও বর্তমানে এদের সংখ্যা বেশ। এসব ভিনদেশি ভিনবাসী মানুষ তাদের দৈনন্দিন ভাষিক প্রকাশ নিঃসন্দেহে নিজেদের মাতৃভাষায় করে থাকে। ফলে রাজধানী ঢাকা শহরে খানিক পরিমাণে হলেও বহুভাষী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তবে নিঃসন্দেহে তা পাশের দেশের রাজধানী বা উন্নত দেশের রাজধানীর বহুভাষী কমোপলিটন চেহারার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
উল্লিখিত কারণসমূহ পর্যালোচনা করে বলা যায়, রাজধানী ঢাকা শহর এখনও ইউরোপ বা আমেরিকার বড় শহরগুলোর তুলনায় যথার্থ অর্থে বহভাষী কসমোপলিটন শহর হিসেবে পরিচিত হয়নি, যদিও জনসংখ্যার বিচারে এটি বর্তমানে পৃথিবীর ১০টি বড় শহরের অন্যতম, যেগুলোর প্রতিটিই এক একটি মেগাসিটি। সব মিলিয়ে ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ শহর এখনও একটি বিদেশিবান্ধব শহর হয়ে ওঠেনি, বা আন্তর্জাতিকতা অর্জন করেনি। বিশেষ করে ভাষিক বিবেচনায় ভিনভাষী বিদেশিরা এখনও এ শহরে কিছুতেই সমাদৃত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পেরিয়ে ঢাকার রাজপথে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এ শহরটি বিদেশি পর্যটক বা অতিথির কাছে একটি ভিনভাষী অপরিচিত শহর ঠেকে। কারণ এ শহরের রাস্তাঘাটে বেসরকারি সংস্থা বা কোম্পানির কিছু ইংরেজি বিলবোর্ড ছাড়া রাস্তাঘাটের দিকনির্দেশনা বা পরিচিতি (যদি থাকে) সবই বাংলায় বা বাংলা লিপিতে লেখা। ফলে বিদেশ থেকে আগত অতিথি, বিশেষ করে প্রথমবার আগমনকারী ব্যক্তি এসব বাংলা বা বাংলা লিপিতে লেখা দেখে সহজেই যোগাযোগহীনতার কারণে ভীত হয়। একমাত্র ভারতীয় ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশীয় বা ইউরোপীয় ভাষার বিদেশিরা বাংলা লিপি দেখে কোনো ‘লিপিগত সাদৃশ্য’ও খুঁজে পান না। এখানে লিপিগত সাদৃশ্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একজন ইংরেজ পর্যটক ইতালি বা জার্মানিতে বেড়াতে গেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি ওই দেশের ভাষা না জেনেও শুধু অভিন্ন রোমান লিপিতে লেখা বিভিন্ন নির্দেশনা ও বর্ণনা পড়ে সংশ্লিষ্ট তথ্য বিষয়ে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন এবং পরিচিত এসব লিপিযুক্ত লেখা দেখে এক ধরনের মানসিক নৈকট্য লাভ করেন। এ বিষয়টি ঢাকায় আগমনকারী বিদেশিদের ক্ষেত্রে ঘটে না। যেহেতু রাজধানী ঢাকায় সরকারিভাবে সবকিছুই বাংলায় লেখা, সেহেতু অপরিচিত বাংলা লিপি দেখে তারা এসবের অর্থ তো উদ্ধার করতেই পারেন না, বরং এগুলো তাদের কাছে অনেকটাই দুর্বোধ্য ‘গ্রিক’রূপে ঠেকে। তবে অনেকেই বলতে পারেন যে, ঢাকায় অধিকাংশ দোকানপাটের সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ড তো ইংরেজি ভাষায় লেখা। এর উত্তরে বলা যায়, এতে হয়তো ইউরোপীয় পর্যটকরা কিছুটা দৃষ্টিগত আরাম খুঁজে পান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই না; কারণ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বা এ দেশের মানুষ সম্পর্কে তারা কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য পান না।
পাশাপাশি এ শহরকে জানা, এর রাস্তাঘাট সম্পর্কে পরিচিত হওয়া, এর যানবাহনগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণালাভ, জাদুঘর, দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপনা, হোটেল, বাজার ইত্যাদি বিষয়ে অবহিত হওয়ার জন্য কোনো পুস্তিকা, পরিচিতিমূলক বই বা মানচিত্র নেই। এ কাজগুলো করার কথা বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা যেমন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বা ঢাকা সিটি করপোরেশনের। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও এসব বিষয়ে উল্লিখিত সরকারি সংস্থাগুলোর কোনো ধারণা বা পরিকল্পনা আছে কি না জানা নেই। সবচেয়ে দুঃখের কথা, আমাদের জানা মতে, এখন পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন জাদুঘর, পর্যটনস্থান, হোটেল, বাজার এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা ইত্যাদির বর্ণনাসহ রাজধানী শহরের সর্বজনীন কোনো মানচিত্র এখনও সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়নি। এ কারণে কোনো বিদেশি পর্যটক বা অতিথি প্রথমবার ঢাকা এসে শুধু ভাষাগত বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ে দ্বিতীয়বার এ দেশে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
ভাষাগত দিক থেকে দৃষ্টিপাত করে উল্লিখিত সমস্যা সমাধানের পথ নিশ্চয়ই রয়েছে। তা ছাড়া সাম্প্রতিক প্রবণতায় দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রয়োজনে বিদেশিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এ ঢাকা শহর বিভিন্ন মানদণ্ডে একটি বহুভাষী কসমোপলিটন শহর হয়ে ওঠার পথে ধাবমান। সেহেতু ঢাকা শহরকে প্রকৃত অর্থে একটি বিদেশি ও পর্যটনবান্ধব নগর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একে একটি দ্বিভাষিক নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
একটি দ্বিভাষিক ঢাকা চাই
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মেগাসিটি ঢাকার বৈশ্বিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্রমে ভিনভাষী বিদেশির আগমনের হার বেড়ে যাচ্ছে। তাই রাজধানী ঢাকাকে একটি দ্বিভাষিক ঢাকা হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এটি বৈশ্বিক দাবিও বটে। বিদেশি ও পর্যটনবান্ধব একটি দ্বিভাষিক ঢাকা বিনির্মাণ বৃহত্তর অর্থে রাষ্ট্রীয় ভাষিক পরিকল্পনার অংশও বটে। তারই একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এখানে তুলে ধরা হলো।
দ্বিভাষিক ঢাকা নির্মাণের বিষয়টি একান্ত অর্থেই বাংলাদেশে আগমনকারী বিদেশি অতিথি ও পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যময় নগর পরিভ্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথমেই ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একটি পর্যটন ইউনিট গড়ে তুলতে হবে। তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলোও তাদের শাখা স্থাপন করতে পারে। এসব পর্যটন ইউনিটে অবশ্যই বিদেশিদের ঢাকা নগর ভ্রমণের তথ্যাদিসহ সুদৃশ্য মানচিত্র থাকবে। বিদেশিদের জন্য এটি অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হবে। তবে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য এর একটি বাংলা সংস্করণও থাকবে হবে। এ ধরনের পর্যটনসংক্রান্ত তথ্য অফিস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি দেশের সব অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর এবং মেট্রোস্টেশন, রেলস্টেশন, বাসস্টেশনেও স্থাপন করতে হবে যাতে দেশিবিদেশি সর্বস্তরের পর্যটক ও অতিথি এ থেকে দেশ ও জাতিসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যগত সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই বিদেশি অতিথি ও পর্যটকরা যাতে স্বচ্ছন্দে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গমন করতে পারেন সেজন্য রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থাকে আরামপ্রদ বাস চালু করতে হবে। পাশাপাশি মেট্রোর সুবিধা তো থাকবেই। এসব বাস এবং মেট্রো ভ্রমণের সময় ভ্রমণসংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা ও ঘোষণা অবশ্যই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে দিতে হবে যাতে বিদেশিরা তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ নির্দেশনা পেতে পারে। তবে আশার কথা, সরকার অধুনা প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মেট্রোতে দ্বিভাষিকতার এ ব্যবস্থাটি সংযোজন করেছে। যারা ইতোমধ্যে মেট্রোতে ভ্রমণ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, প্রতিটি স্টেশনে ওঠানামা করার জন্য এসব মেট্রো ট্রেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা ও ইংরেজিতে ঘোষণা প্রদান করা হয়। পর্যটক ও যাত্রীদের এ দ্বিভাষিক ঘোষণাসুবিধাটি মেট্রোর পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে সব আন্তঃনগর ট্রেন এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাসেও সম্প্রসারিত করতে হবে যাতে ঢাকার যাতায়াতব্যবস্থা প্রকৃত অর্থেই বিদেশি অতিথি ও পর্যটকবান্ধব হয় এবং তারা স্বচ্ছন্দে কোনোরকম অসুবিধা ও সাহায্য ছাড়াই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে ফিনল্যান্ডের অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকির সব বাস, মেট্রো এবং দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে একই সঙ্গে ফিনীয়, সুইডীয় ও ইংরেজি ভাষায় নির্দেশিকা প্রদান করা হয়।
ঢাকা শহরের সব অ্যাভিনিউ, রাস্তা এবং গলির নাম অবশ্যই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে প্রদান করতে হবে। এতে বিদেশি পর্যটকের জন্য দারুণ সুবিধা হবে। এ নামগুলো এমন এক দৃশ্যময় স্থানে স্থাপন করতে হবে যাতে সহজেই পর্যটকের নজরে আসে। গলির নামগুলোর স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা সহজেই ইউরোপীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, রোম, প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন প্রভৃতি বড় শহরে প্রতিটি গলির প্রথম বাড়িটির দেয়ালে দোতলা উচ্চতায় এমনভাবে নির্দেশিকা স্থাপন করে যাতে তা সহজেই পর্যটকের চোখে পড়ে। অনুরূপভাবে, পর্যটকের কথা বিচেনায় নিয়ে ঢাকা শহরের বড় বড় গোলচত্বরের নামও অবশ্যই দ্বিভাষিক হবে।
অ্যাভিনিউ, সড়ক, গলি এবং গোলচত্বরের পাশাপাশি ঢাকা শহরে অবস্থিত সব রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, যাত্রীছাউনি এবং মেট্রোস্টেশনের নাম বাংলার পাশাপাশি অবশ্যই ইংরেজিতে লিখতে হবে। এর ফলে দেশিবিদেশি সব পর্যটক এবং অতিথি সহজেই অন্যের সাহায্য না নিয়ে নিজেই তাদের গন্তব্যস্থানে অনায়াসে গমনাগমন করতে পারবেন। আশার কথা, ঢাকা শহরে সম্প্রতি চালুকৃত সব মেট্রোস্টেশনের নাম বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই প্রদান করা হয়েছে।
ঢাকা শহরে যতগুলো পর্যটনস্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর নাম বাংলা ও ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা যেমন বাংলায় লিপিবদ্ধ থাকবে, তেমন এর হুবহু ইংরেজি অনুবাদও থাকবে যাতে বিদেশিরা সহজেই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন। এ কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ইতিহাসবিদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় বিদেশি অতিথি ও পর্যটক যাতে সহজেই পৌঁছাতে পারেন, সেজন্য সন্নিকটবর্তী রেলস্টেশন, মেট্রোস্টেশন এবং বাসস্টেশনে এগুলোর নাম বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে লিখে রাখতে হবে এবং দিকনির্দেশক হিসেবে তির চিহ্ন দিতে হবে। আনন্দের কথা, নতুন প্রতিষ্ঠিত মেট্রোস্টেশনে স্টেশনসংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর নাম বাংলায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো বিদেশি পর্যটকবান্ধব করার জন্য অবশ্যই এর ইংরেজি রূপটি প্রদান করতে হবে।
ঢাকা শহরে বেশ কিছু জাদুঘর রয়েছে, যদিও তা পৃথিবীর অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। বিভিন্ন বিষয়ের জাদুঘরের উপস্থিতি একটি নগর বা শহরের আভিজাত্য, মহিমা, গৌরব এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিদেশি পর্যটকরা কোনো নগরে গমনের পর তাদের ভ্রমণসূচিতে অবশ্যই তা অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ঢাকা নগরীতে অবস্থিত বিভিন্ন জাদুঘরে যে বস্তুগুলো প্রদর্শন করা হয় সেগুলোর নাম এবং বর্ণনা বাংলা ও ইংরেজি এ দুই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ করতে হবে। এর ফলে এসব জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রদানকৃত বর্ণনাপাঠে পর্যটকরা ঢাকা নগরকে আরও অর্থপূর্ণভাবে জানতে ও বুঝতে সক্ষম হবে।
রাজধানী ঢাকা শহরের মর্যাদা বাড়িয়ে তোলা নাগরিক হিসেবে যেমন সব নাগরিক বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি আবশ্যিক দায়িত্ব, তেমন এর আন্তর্জাতিক পরিচায়নের ব্যবস্থাটিও ঢাকাবাসীকেই নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত ক্ষেত্রসমূহে বাংলার পাশাপাশি এর ইংরেজিকরণই মোক্ষম পন্থা বটে। ইংরেজিনির্ভর দ্বিভাষীকরণের এই যে রূপরেখা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো, তা নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও আদর্শের পরিপন্থি নয়। কেননা এ দ্বিভাষীকরণে বাংলা ভাষার মর্যাদা অবশ্যই অক্ষুণ্ন রাখা হচ্ছে। তবে দ্বিভাষীকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাকে আগে স্থান দিয়ে তারপর ইংরেজি রূপটি লিখতে হবে। পাশাপাশি এ দ্বিভাষীকরণের ফলে ঢাকা নগরী অনেক বেশি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
রাজধানী শহরের দ্বিভাষীকরণের এ প্রচেষ্টাটি অবশ্যই ভাষানীতি ও পরিকল্পনার একটি ব্যষ্টিক অংশ। আর এর দেখভালের দায়িত্বও নিশ্চয়ই সরকারি সংস্থার ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ দ্বিভাষীকরণ প্রক্রিয়া ও এর দেখভালের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে সহজেই দায়িত্ব পালন করতে পারে।