× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ফয়েজ আহ্‌মদ : অনন্য সাংবাদিক

মো. জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১২:০৫ পিএম

উপমহাদেশের বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক ফয়েজ আহ্‌মদ

উপমহাদেশের বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক ফয়েজ আহ্‌মদ

উপমহাদেশের বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক ফয়েজ আহ্‌মদের ত্রয়োদশতম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন তিনি। মধ্যরাতের অশ্বারোহীখ্যাত এ সাংবাদিক-সাহিত্যিকের জন্ম ১৯২৮ সালের ২ মে বিক্রমপুরের শ্রীনগর-বাসাইলভোগ গ্রামে প্রখ্যাত চৌধুরী পরিবারে। আমার বাবা চাচারা তার সহপাঠী ছিলেন। আমি স্কুলে পড়াকালে তার কথা জানতে পারি। তিনি ও আমি একই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামের সন্তান। একই স্কুলের ছাত্রও আমরা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে তিনি ষোলঘর একেএসকে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছেন। তার ছাত্রত্বকালে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি ও শ্রীনগর শ্রীনাথ হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন ডা. মন্মথ নাথ নন্দী। ডা. নন্দীর সংস্পর্শে এসে ফয়েজ আহ্‌মদ স্কুলজীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। আমৃত্যু সেই মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেই চলেছেন, বিচ্যুত হননি।

কিশোর বয়সে তিনি ছিলেন খুব ডানপিটে। ভালো হাডুডু খেলতেন। বাবাকে ফাঁকি দিয়ে হায়ারে হাডুডু খেলতে যেতেন। জীবনের প্রথম রুজি ৫ টাকা হাডুডু খেলেই পেয়েছিলেন। ষোলঘর একেএসকে উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তার লেখা ছড়া ‘নামের বিভ্রাট’ প্রকাশিত হয় কলকাতার সাহিত্য পত্রিকা ‘সওগাত’-এর শিশু বিভাগে। ছাপার অক্ষরে নিজের ছড়া দেখে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা গিয়ে সওগাত অফিসে দেখা করেন সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের সঙ্গে। কিশোর ফয়েজ আহমদ সাহিত্য সম্পাদককে বলেন, ‘নামের বিভ্রাট ছড়ার লেখক আমি।’ আহসান হাবীব বলেন, ‘এ বিভাগে বড়রা লিখে ছোটদের জন্য। এই ছড়ার লেখক তুমি এটা আগে জানতে পারলে তো ছাপতাম না।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি মুন্সিগঞ্জে বড় বোনের বাড়ি বেড়াতে যান। বেড়ানো শেষে নিজ গ্রামে ফেরার সময় বোন আদরের ছোট ভাই ফয়েজকে টাকা দেন। তিনি বাড়ি না এসে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে সোজা চলে আসেন কুর্মিটোলা এয়ারফোর্স ব্যাসে। ইন্টারভিউ দিয়ে টিকে যান বিমান সেনা পদে। ট্রেনিং শেষে ফাইনাল পোস্টিংয়ের ঠিক আগমুহূর্তে বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়। তাদেরও বিদায় দেওয়া হয়। এদিকে বাড়িতে তাকে খোঁজার জন্য চারদিকে লোকজন হয়রান। এমন একদিনে হাজির হন বাড়ি। 

তার বাবা মোস্তফা চৌধুরী ছাত্রজীবনে ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের গভর্নর (গৃহশিক্ষক)। খাজা নাজিমউদ্দিন ও খাজা শাহাবুদ্দিনকে তিনি পড়াতেন। খাজা নাজিমউদ্দিন বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার সময় মোস্তফা চৌধুরী ছাত্রের সঙ্গে বোম্বে গিয়ে স্টিমারে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন সব সময় তার শিক্ষককে স্মরণ করতেন। চিঠি লিখতেন, নানা ধরনের উপহার পাঠাতেন।

ফয়েজ আহ্‌মদ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পড়তে এসে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। দীর্ঘ চার দশকের সাংবাদিকতা পেশায় ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পূর্বদেশ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার, হুল্লোড়, স্বরাজ ও বঙ্গবার্তা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ রাতে তিনি ঢাকা প্রেস ক্লাবে আটকা পড়েন। গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলায় মারাত্মক আহত হন। অতি সতর্কতা ও কষ্ট সহ্য করে গ্রামের বাড়ি চলে যান। পরে আগরতলা হয়ে কলকাতা গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একাধিকবার মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হন। স্বাধীন বাংলা বেতারে বিশ্লেষণমূলক কথিকা ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’-এর লেখক ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ। যাতে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয় সংবাদ সংস্থা (বাসস) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংস্থাটির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন।

দেশের বাইরেও সাংবাদিকতায় অবদান রেখেছেন। গণচীনের বেতারে বাংলা অনুষ্ঠানের (১৯৬৬-৬৭) প্রবর্তক তিনি। সাংবাদিকতার সঙ্গে শিশু-কিশোরদের জন্য সংগঠন গড়েছেন। শিশুদের জন্য লিখেছেন ছড়া, কবিতা, গল্প। ঢাকা বেতারের শিশুদের অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন কয়েক বছর। বড়দের জন্যও লিখেছেন প্রচুর। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। সাড়া জাগানো বই ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ ও ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত হয়; যা সাংবাদিকতার অন্তর্দৃষ্টির অভিনব ধারার সংযোজন হিসেবে সবার স্বীকৃতি লাভ করে।

ফয়েজ আহ্‌মদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। সভাপতি ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। ফয়েজ আহ্‌মদ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা বিকাশে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে পাকিস্তান সরকারকে ফাঁকি দিয়ে তিনি বিনা পাসপোর্টে আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহায়তায় যোগ দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৯৫৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে চীন ও উত্তর কোরিয়ার আমন্ত্রণে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের লেখকের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে দেশ দুটিতে মাসব্যাপী সফর করেন। ১৯৯৫ সালে মার্কিন ব্লকেডবিরোধী হাভানায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এবং একই বিষয়ে হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন ‘ফোবানা’র নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক। শহীদ মতিউর স্মৃতিসংসদ, ঢাকা লিটল থিয়েটার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি উদ্যোগ নিয়ে দুই নেত্রীকে একত্রে বসিয়ে স্বৈরাচারের পরাজয় ও বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেন। তিনি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়র সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৯১ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের এগারো বিচারকের একজন ফয়েজ আহ্‌মদ। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে জনগণের পক্ষে থাকার কারণে তিনি বেশ কবার মিলিয়ে চার বছর কারাভোগ করেন।

ফয়েজ আহ্‌মদ ঢাকার প্রাচীন আর্ট গ্যালারি ‘শিল্পাঙ্গন’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার, সাব্বির শিশুসাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার, মোদাব্বের-হোসনে আরা শিশু সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯১ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ, ঋষিজ ও জাতীয় কবিতা পরিষদ তাকে সম্মাননা প্রদান করে।

ডা. এমএন নন্দীর স্মরণসভায়, বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথি করে তাকে শ্রীনগর নিয়ে গিয়েছিলাম। জীবনের শেষ দিকে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি অন্যের সহায়তায় লেখালেখি করতেন। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বরেণ্য সাংবাদিক-সাহিত্যিক ফয়েজ আহ্‌মদের জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর আগে তিনি চোখের কর্নিয়া সন্ধানীকে ও দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন। সাংবাদিকতা জগতের অভিভাবক, খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক, কবি ফয়েজ আহমদ তার কর্মজীবন এবং রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও অন্যতম সংগঠক। ত্রয়োদশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

  • বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা