ইউক্রেন
নিরঞ্জন রায়
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫০ এএম
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পেছনে যে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল বলে বিশেষভাবে আলোচনায় আছে, তার অন্যতম ইউক্রেনের পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়া। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হওয়া এবং ন্যাটোও চাচ্ছিল ইউক্রেনকে সদস্য করে রাশিয়াকে বেশ চাপে ফেলতে। অন্যপক্ষে রাশিয়া প্রথম থেকেই ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছে। রাশিয়ার বিরোধিতা উপেক্ষা করে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে থাকে এবং রাশিয়া এ পদক্ষেপ থামানোর উদ্দেশ্যেই ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে। শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মধ্যেই ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে যায় এবং অনেক আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়। পরিপূর্ণ সদস্য হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে যায় এক ধরনের ছন্দপতন। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসনের বিদায় ঘটে এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই বলে আসছেন তিনি নির্বাচিত হয়েই অতিদ্রুত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবেন। সে উদ্যোগ শুরুও হয়ে গেছে এবং এর প্রভাব ইতোমধ্যে দেখাও দিয়েছে।
এ যুদ্ধের উত্তেজনা অনেকটাই স্তিমিত। ফলে যুদ্ধ তো বন্ধ হবেই, উপরন্তু ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়াও কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা এবং এর সম্ভাব্য শেষ পরিণতির বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে তার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত যেসব প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, তাদের সবাই প্রকাশ্যে ইউরোপের রাষ্ট্রনায়কদের সমালোচনা করেছেন। তারা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের বিষয়টি সঠিকভাবে হ্যান্ডল করতে পারেননি ইউরোপের নেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিনিধি তো বলেই ফেললেন যে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার শর্ত জুড়ে দিলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শাঁখের করাত হয়ে দেখা দেবে।
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিত প্রতিনিধিদের বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা না করেও দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ইউক্রেন এ সামরিক জোটে যোগ দেবে। তিনি যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে ইউক্রেনের অবস্থান শক্ত হতে হবে- যা একমাত্র ন্যাটোয় যোগদানের মাধ্যমেই সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের জন্য যদি ভালো একটি সমঝোতা না হয়- তাহলে সে ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং তাদের মিত্রপক্ষ যেমন উত্তর কোরিয়া, ইরান ও চীন এক ধরনের বিজয় উল্লাস করবে। তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে সম্মত হওয়ার আগে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যে- রাশিয়া আর কখনও ইউক্রেন আক্রমণ করবে না। তার মতে, এ রকম নিশ্চয়তা তখনই আদায় করা সম্ভব, যখন ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে।
দাভোসের সেই বার্ষিক সভায় ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের বিশেষ মিশন দূত (এনভয়) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রিচার্ড গ্রেনেল। তিনি ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেলের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করেন, ন্যাটোর বিস্তৃতি বাড়ানোর কারণে বাড়তি অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য মার্কিনিরা মোটেই প্রস্তুত নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে ন্যাটোর শর্তানুযায়ী অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের জিডিপির ২ শতাংশ পরিমাণ অর্থ ন্যাটোয় প্রদান করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও অনেক সদস্য রাষ্ট্র সেটা করছে না।
গ্রেনেল ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল রুটকে উদ্দেশ করে বলেন, তিনি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যা করার জন্য চাপ দিয়ে প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রকে শাঁখের করাতের মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, মার্কিনিরাই প্রতিরক্ষা ব্যয়ভার বহন করে চলেছে। অথচ অন্য সদস্য
রাষ্ট্র ন্যাটোয় যে বরাদ্দ প্রদানের কথা, তা তারা করছে না। এই বলে তিনি অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রকে ন্যাটোয় অর্থ প্রদানের বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসকে ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেন। উল্লেখ্য, ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট নেদারল্যান্ডসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
সেই বার্ষিক সভায় উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের আরেক প্রতিনিধি। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন বিবদমান স্থানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে মার্কিনিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করতে চান। এই বলে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ইউরোপের নেতাদের দায়ী করে জানান যে- তারা বিগত তিন বছরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে একটি বারের জন্য হলেও কথা বলেননি। তার মতে, ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বাস করে আলোচনাই হচ্ছে সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। এ প্রসঙ্গে গ্রেনেল উল্লেখ করেন, ইউরোপে এত বৈদেশিক মন্ত্রী ছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন অনেক উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক; অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে তারা কেউই এ যুদ্ধ বন্ধে কোনোরকম পদক্ষেপ নেননি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে জো বাইডেন এবং পুতিন বিগত সাড়ে তিন বছরে একবারের জন্য হলেও নিজেদের মধ্যে কথা বলেননি।
দাভোসের বার্ষিক সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যোগ দিয়েছিলেন রিপাবলিক দলের দুজন সিনেটর, তারা উভয়েই একটু কৌশলী হয়ে ভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে আমাদের কাছে এখন যুক্তরাষ্ট্র সবার ওপরে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র একা চলবে। যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু এবং অংশীদারদের সঙ্গে নিয়েই চলবে বলে তারা দুজনেই উল্লেখ করেন। ইউরোপের অন্য নেতারা অবশ্য ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেলের বক্তব্য সমর্থন করেই কথা বলেন। দাভোস সভায় উপস্থিত ছিলেন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট, তিনি প্রথমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সবার আগে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান। এ সভায় ন্যাটোর সাবেক প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ উপস্থিত ছিলেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তিনি বলেন, তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ হচ্ছে যুদ্ধে হেরে যাওয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক্স বার্তায় জানিয়ে দেন যে- রাশিয়া যদি যুদ্ধ বন্ধ আলোচনায় সম্মত না হয় তাহলে তার প্রশাসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেক উচ্চহারে শুল্ক ধার্য এবং অধিক মাত্রায় বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এ কথার পাশাপাশি ট্রাম্প এও বলেছেন, তিনি পুতিনকে চটাতে চান না। তিনি যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে একটা পরিষ্কার মেসেজ দিয়ে বলেছেন যুদ্ধ বন্ধ হতে হবে। সেটা খুব সহজে হবে, না হয় কঠিনভাবে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রশক্তি, বিশেষ করে ন্যাটোর সদস্য দেশ জোটবদ্ধ হয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করেছে। এ যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র একজোট হয়ে অর্থ দিয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং সকল প্রকার সমর্থন জুগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে একসঙ্গে রাশিয়ার বিপক্ষে সকল প্রকার অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। যেমন রাশিয়ার ওপর কঠোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা রাখা রাশিয়ার ডলার হিসাব জব্দ, রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে সুইফট থেকে বহিষ্কার। এ রকম আরও পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্র দেশ একযোগে গ্রহণ করেছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ইউক্রেন সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহযোগিতার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কোনোরকম মতবিরোধ লক্ষ করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভের পরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে, যা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে সুইজারল্যান্ডের দাভোস সভায়। ট্রাম্পের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসন এভাবে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার পক্ষে নয়। অথচ ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল বলছেন, ইউক্রেন একপর্যায়ে ন্যাটোর সদস্য হবেই। কোন অবস্থাটা বাস্তবে ঘটবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে যতটা ধারণা করা যায় এবং তাতে সংশয় দেখা দিয়েছে, ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছা কি স্বপ্নই থেকে যাবে?