× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রপ্তানি খাতের অপার সম্ভাবনা কাঁকড়া

দুলাল আচার্য

প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৬ এএম

দুলাল আচার্য

দুলাল আচার্য

একসময় জলজপ্রাণী কাঁকড়াকে মনে করা হতো অপ্রয়োজনীয়। অথচ সময়ের হাত ধরে কাঁকড়া হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্ভাবনাময় এক সম্পদ। কাঁকড়া অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার নাম। সহজ করে বললে রপ্তানি পণ্য। একসময় খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, সাগরে প্রচুর কাঁকড়ার দেখা মিলত। তখন কাঁকড়া আহরণে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি এখন শহরের মানুষের খাদ্য তালিকায়ও কাঁকড়া স্থান করে নিয়েছে। ইদানীং অভিজাত হোটেলগুলোতে খাদ্যের পছন্দের তালিকায় কাঁকড়ার নাম যুক্ত হয়েছে। জানা গেছে, পৃথিবীর ২৪টির বেশি দেশে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, ভারত, মিয়ানমার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কাঁকড়ার সুখ্যাতি রয়েছে।

উপকূলবর্তী এলাকার ফসলহীন জলাভূমিতে কাঁকড়ার চাষে ভাগ্যের চাকা ঘুরছে লাখ লাখ চাষির। দেশ পাচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। অনেক স্থানে চিংড়ির ঘেরগুলো কাঁকড়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চিংড়ির আড়তের চেয়ে কাঁকড়ার আড়তের সংখ্যা। কয়েক বছর আগেও চিংড়ি ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনীতির প্রতিভূ। কিন্তু এখন চিংড়ির স্থান অনেকটা দখল করেছে জলজ এ প্রাণীটি। উৎপাদন কমে যাওয়া এবং চিংড়ি চাষে নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় চাষিরা এদিকে ঝুঁকেছে। কম খরচে, কম শ্রমে ব্যাপকহারে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। রপ্তানি খাতে কাঁকড়ার মূল্য আর চাহিদা ইলিশ, চিংড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী জাতীয় মাছ ইলিশ ও চিংড়ির পরই কাঁকড়ার স্থান। চাষকৃত প্রতিটি পরিপূর্ণ কাঁকড়ার ওজন এক কেজি থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, সুন্দরবনের ৬০ হাজারের বেশি পরিবার কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। কাঁকড়া রপ্তানি করে প্রতি বছর গড়ে আয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

প্রাকৃতিকভাবে মূলত নোনা পানিতে কাঁকড়া জন্মায়। সে কারণে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েক হাজার কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামারও গড়ে উঠেছে। জানা গেছে- খুলনা, বাগেরহাট, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, সুন্দরবন, সীতাকুণ্ড, মহেশখালী, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, চকরিয়াসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ করা হয় । শুধু সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার পুরোটা জুড়েই কাঁকড়া চাষ হয়। পাইকগাছাতেই ৩০০-এর বেশি খামার রয়েছে। সাতক্ষীরার মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জেলার ৩২১ হেক্টর এলাকা জুড়ে কাঁকড়া চাষ হয়। তবে কক্সবাজারে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতিতে। কাঁকড়া চাষের জন্য জমির আয়তন তেমন কোনো বিষয় নয়। শুধু প্রয়োজন নেট, পাটা, পুঁজি ও খাদ্যের। এক বিঘা জমিতে কাঁকড়া চাষ করতে হলে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। এতে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করা যায়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৩ সালে কাঁকড়া পোনা চাষ বিষয়ে গবেষণা শুরু করে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ইউএসআইডির অর্থায়নে ও আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ অ্যাকোয়াকালচার ফর ইনকাম অ্যান্ড নিউট্রিশন প্রকল্পের যৌথ তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারে একটি হ্যাচারিতে কাঁকড়ার উৎপাদনে নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, ১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ কাঁকড়া রপ্তানি শুরু করে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৭৩ টন, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪১৬ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৮ হাজার ৫২০ টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দ্বিগুণ কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশে ৯ হাজার ৭৮৮ দশমিক ৭২ টন কাঁকড়া রপ্তানি করে ৬ কোটি ২৮ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯১ ডলার আয় হয়েছে। আগের বছর ৭ হাজার ৪৫২ দশমিক ১৫ টন কাঁকড়া রপ্তানি করে ৪৪৫ দশমিক ১৯ কোটি টাকা আয় হয়েছিল। কেবল সাতক্ষীরায় প্রতি বছর ৩ হাজার টন কাঁকড়া উৎপাদিত হয়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পরই কাঁকড়া উৎপাদনে সাতক্ষীরার স্থান। দুই ভাবে কাঁকড়া বিদেশে পাঠানো হয়Ñ সফট সেল ক্র্যাব হিমায়িত করে এবং হার্ড সেল ক্র্যাব হচ্ছে, জীবিতাবস্থায় কাঁকড়া বিদেশে পাঠানোর পদ্ধতি।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, কাঁকড়া ১০ পাযুক্ত উভচর প্রাণী। শরীরের সম্মুখভাগে রয়েছে কাঁটাওয়ালা দুটি দাঁড়াযুক্ত পা, যা ওরা হাত হিসেবে ব্যবহার করে। পা দুটি দিয়ে খাবার তুলে খায় এবং শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন বাঁচায়। কাঁকড়ার চলনভঙ্গি অদ্ভুত। এরা মূলত পানিতে থাকলেও ডাঙায়ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে। দেশের প্রায় সব জলাশয়ে কাঁকড়ার বাস। ১৩৩ প্রজাতির কাঁকড়ার সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে আমাদের দেশে ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া চাষ হয়। এর মধ্যে ১১ প্রজাতির কাঁকড়া সামুদ্রিক। শক্ত খোলে আবৃত জলজ এ প্রাণীর দৈহিক গঠন বিভিন্ন রকমের। সাগরের কাঁকড়া লাল এবং অন্যান্য জলাশয়ের কাঁকড়া কালো রঙের। এরা চলে সামনে বা পেছনে নয়, পাশে। ডাঙায় বিচরণকালে কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা দেখলেই চোখের নিমেষে ছুটে অদৃশ্য হয়ে যায়। এদের চোখ দুটি অদ্ভুত। চোখ দুটি ইচ্ছেমতো প্রসারিত বা বন্ধ রাখতে পারে।

কাঁকড়ার বড় শত্রু কারেন্ট জাল। জালে যখন মাছ আটকা পড়ে তখন কাঁকড়া সে মাছ খেতে গিয়ে নিজেও আটকা পড়ে যায়। গ্রামের অনেকেই ভয় পেয়ে কাঁকড়া মেরে থাকে। এ ছাড়া কাক, চিল, শেয়াল, বেজি এবং বাঘ কাঁকড়া খেয়ে থাকে। এভাবে কাঁকড়ার বংশ হ্রাস পাচ্ছে। স্ত্রী কাঁকড়া তেলাপিয়া মাছের মতো নিজের পেটসংলগ্ন থলেতে ডিম বয়ে নিয়ে বেড়ায়। মায়ের দেহের উষ্ণতায় ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষ কাঁকড়ার চেয়ে স্ত্রী কাঁকড়ার দাম বেশি এবং খেতেও সুস্বাদু। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, কাঁকড়ার মাংসে বেশ পুষ্টিগুণ আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মাংসে পুষ্টিমান আছে পানি ৭ গ্রাম, প্রোটিন ১৯ থেকে ২৪ গ্রাম, চর্বি ৬ গ্রাম এবং খনিজ পদার্থ ১-২ গ্রাম।

চাষিরা বলছেন, কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে কিছু সতকর্তা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষ করে কাঁকড়া চাষের পুকুরের তলায় জমে থাকা বিষাক্ত ক্ষতিকর গ্যাস শুঁষে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করতে হবে। জিওলাইট প্লাস দিতে হবে প্রতিটি ফ্যাটিনিং চাষের পর। এরা যেহেতু জীবিত খাবার এবং প্রোটিনযুক্ত খাবার খায় ফলে খামারের তলায় অভুক্ত খাবার থেকে গ্যাস তৈরি হতে পারে। উপযুক্ত রাসায়নিক দিয়ে সেই অবাঞ্ছিত গ্যাস শোষণ করা সম্ভব হবে। প্রতি দুবার ফসল তোলার পর পুকুরের তলায় জমে থাকা পলি তুলে ফেলে পাথুরে চুন দিয়ে সাত দিন পুকুরে ফেলে রাখার পর আবার পানি ঢোকাতে হবে। দ্বিতীয়ত. কাঁকড়া গর্ত কেটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে। এ স্থানান্তর এড়াতে স্লুইস গেটসহ খামারের চারদিকে বাঁশের পাটা ও নাইলন জালের বেড়া দিতে হবে, যা মাটির নিচে অন্তত ২ ফুট এবং মাটির ওপরে অন্তত ৩ ফুট থাকে। প্লাস্টিক শিট পাড়ের ওপর দিয়ে তার ওপর মাটি দিয়ে পাড় তৈরি করলেও কাঁকড়া পাড় ফুটো করে চলে যেতে পারবে না। যেহেতু কাঁকড়া একে অন্যকে খেয়ে ফেলতে পারে, এ প্রবণতা এড়াতে নিয়মিত অতিরিক্ত খাদ্যের জোগান রাখা জরুরি। খোলস যত তাড়াতাড়ি শক্ত হবে ততই বিক্রয়োপযোগী হবে, সে কারণে পানির গুণাগুণ উপযুক্ত মাত্রায় রাখা জরুরি। খামারে নরম কাঁকড়াগুলোর প্রয়োজনীয় লুকানোর জায়গা রাখা জরুরি। ভাঙা পাইপ, অব্যবহৃত টায়ার ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে পারে লুকানোর আস্তানা হিসেবে, ১৫ সেমি ব্যাসার্ধের লম্বা পাইপের টুকরাগুলো খামারের তলদেশে ছড়িয়ে রাখতে হবে। খামারের মাঝখানে উঁচু মাটির ঢিবি বানিয়ে তাতে লবণাম্বু উদ্ভিদের কিছু চারা যেমন হেঁতাল, গেওয়া লাগালে কাঁকড়া যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তেমন পানির অতিরিক্ত খাদ্য শোষণ করে নিয়ে পানি দূষণমুক্ত রাখে। গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়া চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সালে সনাতন পদ্ধতিতে পুকুরে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে প্রথম হংকংয়ে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। কাঁকড়া উৎপাদনের ব্যাপারে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে জোরালো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে বাংলাদেশে কাঁকড়া চাষ পুরোপুরিভাবে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণের ওপর নির্ভরশীল। চাষের ব্যাপকতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি মুনাফালাভের আশায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্বিচার মা কাঁকড়া, পোনা এবং অপরিপক্ব ছোট কাঁকড়া আহরণের প্রবণতা বাড়ছে। তাই কাঁকড়া চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বর্তমানে প্রচলিত প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্বিচার অপরিপক্ব বা ছোট কাঁকড়া ধরার প্রবণতা রোধ করার জন্য এর পোনা উৎপাদন এবং চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। অপরিপক্ব ও ছোট কাঁকড়া আহরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রমবর্ধমান কাঁকড়াশিল্প মুখথুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কাঁকড়া চাষ দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল রাখতে হলে চিংড়ির মতো হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন প্রয়োজন। নৌযানের সুবিধা থাকলে সাগর থেকে কাঁকড়া ধরে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধিশালী হবে। কাঁকড়া উৎপাদনে দেশের সর্বত্র চাষিদের ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, গ্রামে-গঞ্জে পুকুর-নালা খনন করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মৎস্য অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাষিদের কাঁকড়া উৎপাদনে উৎসাহিত করলে বেকারত্বের হার কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। কাঁকড়ার বিলুপ্তি যাতে না ঘটে- সে ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ জরুরি।

  • লেখক ও সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা