সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:২৭ এএম
দেশে প্রায়ই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। বিশেষ করে বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, যানবাহন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা গ্যাস স্টেশনগুলোতে। এবার সাভারের আশুলিয়ায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নারী-শিশুসহ এক পরিবারের ১১ জন দগ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের সাতজনই শিশু ও কিশোর। ছয়জনের শ্বাসনালিতে বার্ন রয়েছে বলে চিকিৎসকরা বলেছেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত ১০টায় আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের গুমাইলের আমজাদ ব্যাপারীর দোতলা বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর দ্রুত তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতে শবেবরাতের রুটি ও পিঠা বানানোর সময় হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। এতে সুমনের কক্ষে আগুন ধরে পরিবারের শিশু, নারীসহ মোট ১১ জনের গায়ে আগুন ধরে যায়। ঘটনাটি মর্মান্তিক ও অপ্রত্যাশিত।
বাসাবাড়িতে দিনদিন এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ড। শুধু বাসাবাড়িতেই নয়, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচল করছে। এমনকি বেলুন ফোলানোর কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও মানুষ হতাহতের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহারযোগ্য নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। সরকারের বিস্ফোরক অধিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর। এ সময় পরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। তাই মেয়াদ শেষ হলে সেগুলো বাতিল করা উচিত, এটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ কাণ্ডজ্ঞানের ঘাটতি অত্যন্ত প্রকট। কত বছর ধরে একটি সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবহারকারী অনেকের কাছে সে হিসাবও থাকে না। বর্তমানে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে ৬০ লাখেরও বেশি গ্রাহক। গ্রামগঞ্জেই এ গ্রাহকের সংখ্যা বেশি।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে সারা দেশে ২৬ হাজার ৬৫৯টি এবং দিনে গড়ে ৭৩টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গ্যাসসংক্রান্ত কারণে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এ ছাড়া আগুনের ঘটনায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলাও রয়েছে। এ অগ্নিকাণ্ডে ৪৪৬ কোটি ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৬৯৭ টাকা সম্পদের ক্ষতি হয়। ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৭৫ টাকার সম্পদ রক্ষা করেছে বলে তথ্যে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে ৩৪১ জন আহত ও ১৪০ জন নিহত হয়। বিস্ফোরণ অধিদপ্তরের তথ্য, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৩০টি কোম্পানির ২ কোটি সিলিন্ডার রয়েছে। তবে বছরে কত মানুষ এভাবে মৃত্যুবরণ করে কিংবা কত মানুষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায় এর কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। কেবল বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে কিছু অনুমাননির্ভর চিত্র পাওয়া যায়। তবে সেটা সঠিক পরিসংখ্যান বলা যাবে না। এ থেকেই ধারণা করা যায়, সিলিন্ডার গ্যাস বিস্ফোরণের মতো সমস্যাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারগুলো অনেক সময় শক্তিশালী বোমার সঙ্গে তুলনীয়। এর আগে দেশের বহু স্থানে এ রকম গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা শক্তিশালী বোমার মতো দৃশ্যমান হয়েছিল। যদিও গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা নানাভাবে ঘটতে পারে। সিলিন্ডার ভালো থাকলেও নিম্নমানের রেগুলেটর ব্যবহার করা হলে আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময় গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যথাযথ সতর্কতা ও সচেতনতার অভাবেও দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা মনে করি, এসব সমস্যা দূর করার জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে আরও সক্রিয় হতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস সিলিন্ডারের গুণগত মান নিশ্চিত করা, সেগুলোর নিয়মিত পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর নিয়মিত নজরদারি জোরালো করা প্রয়োজন। বেসরকারি যেসব কোম্পানি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করে, তারা কী মানের সিলিন্ডার সরবরাহ করে, সেগুলোর নিরাপত্তার অবস্থা কী, কতদিন ব্যবহারযোগ্য ইত্যাদি বিষয়েও নজরদারির কথা ভাবতে হবে।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা বন্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। সাভারের আশুলিয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক কাম্য নয়। তাই দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে সারা দেশে গ্যাস ব্যবহারে মানুষের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবহারকারীদের আরও সচেতন হতে হবে। রান্না শুরু করার আধা ঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে। রান্না শেষে চুলার নব ও সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রান্নাঘরেই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিংগুইশার ও কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। আমরা মনে করি, গ্যাস সিলিন্ডারের গুণগত মান নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষীয় নজরদারি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ প্রয়োজন এবং বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সেটা নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার বন্ধ হোক।