× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিক্ষার মাধ্যম

মাতৃভাষা চর্চার বিকল্প নেই

মাহজাবিন আলমগীর

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:২২ এএম

প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসছে। তবে শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে-পড়তে জানে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসছে। তবে শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে-পড়তে জানে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষসাধন। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সে উদ্দেশ্য থেকে যেন অনেকটাই ছিটকে পড়েছে। যেন পরিণত হয়েছে মূলত মার্কশিটসর্বস্ব সনদপত্র তৈরির উন্নত কারখানায়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমেই লেখাপড়া করে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত কেবল মাতৃভাষা। অথচ দেশে কয়েক ধারার যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত, তা শৈশব থেকেই ছাত্রছাত্রীদের বিচ্ছিন্ন করছে, বিভেদ-বৈষম্য তৈরিতে সহায়তা করছে। এছাড়া প্রায় প্রতিবছর বাংলা মাধ্যমের পাঠক্রমের ওপর যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে তা হয়তো নজিরবিহীন। বাংলা মাধ্যমে প্রতি বছরই পাঠক্রমে পরিবর্তন, পরিবর্ধন আসে; ছাত্রছাত্রীদের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়ছে কি না তার মান যাচাই করা হয় না। অথচ অন্য দুটি প্রধান মাধ্যমের শিক্ষাক্রমে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। আবার বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক স্তরেই চাপিয়ে দেওয়া হয় ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন তবে তারও একটা সময় থাকা দরকার। যে বয়সে কোমলমতি শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের সময় তখন বাধ্যতামূলকভাবে অন্য ভাষা চাপিয়ে দিয়ে তাদের ভারাক্রান্ত করা হয়।

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা যেন বাড়ছে। শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা চর্চায় আমরা যেন অনেকটা পিছিয়ে পড়ছি। প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসছে। তবে শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে-পড়তে জানে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীও মনে করে বাংলা বিষয়ে কোনোভাবে পাস করলেই চলবে। বাংলা ব্যাকরণ বলে যে বিষয়টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হয় সেটি সর্বাপেক্ষা কম পঠিত বলে বিবেচিত। বাংলা ব্যাকরণ ভালোভাবে শেখবার বা আত্মস্থ করবার প্রয়াস খুবই কম। অথচ শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে গেলে ব্যাকরণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। অভিভাবকরা মনে করেন পাস করে উচ্চশিক্ষার্থে সন্তান বিদেশে পাড়ি জমাবে, মাতৃভাষাটা ঠিকঠাক না জানলেও চলবে, কিন্তু সর্বাগ্রে ইংরেজি জানা চাই।

অভিভাবকদের ভেতরও ইংলিশ মাধ্যমে পড়ানো অনেকটাই শিক্ষার অনিবার্য মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ায় মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো, অথচ বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল ও করুণ দশা দৃষ্টি এড়ায় না। তাদের বাহারি নাম ও চাকচিক্যের জৌলুস বাংলা মাধ্যমকে ক্রমে পিছিয়ে দিচ্ছে। সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে এটা বলতে পারাটাই যেন গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব স্কুলে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে বড় হচ্ছে। নিজের সংস্কৃতি যথার্থভাবে জানবার জন্য দরকার নিজের মাতৃভাষাটা ভালোভাবে চর্চার। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখা অবশ্যই দরকার কিন্তু তার আগে তো প্রয়োজন নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ শক্ত করা। 

অনেকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দেশে উচ্চশিক্ষার পারিভাষিক শব্দাবলি গ্রিক ও লাতিন থেকেই বেশিরভাগ এসেছে। উচ্চশিক্ষার বিবরণাত্মক দিকটি বাংলা ভাষা সহজেই গ্রহণ করতে সক্ষম। বিদেশি ভাষার শব্দাবলির সেগুলো প্রচলিত থাকা উচিত যেগুলো যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে ভাষার অলংকরণ বৃদ্ধি করছে, সেগুলো ব্যবহারিক ভাষা থেকে আলাদা করা যায় না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষায় পরিবর্তন, পরিমার্জন আসবেই। কারণ, ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিবিপ্লবের প্রভাবে বাংলার ব্যবহার সর্বত্রই কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলা ভাষা তার স্বরূপ হারিয়ে ফেলবে। অথচ বাংলা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা, ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে এর অবস্থান ইংরেজি বা জার্মানির থেকে কোনো অংশেই কম নয়। এর সৃষ্টিশীলতার ক্ষমতা অনেক বেশি। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক রচনা রয়েছে, বিশ্বসাহিত্যেও যা দুর্লভ। অথচ বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি সুচতুরভাবে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে। আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ হতে হবে।

বাংলা ভাষা যদি আমরা সর্বস্তরে প্রচলন করতেই না পারি তাহলে আমাদের সাফল্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আইন-আদালত, সরকারি অফিসের ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন দরকার। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আইন-আদালত, প্রশাসনিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা প্রচলনের কার্যকর উদ্যোগ কোনো নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও প্রযুক্তিবিপ্লবের যুগে ইংরেজির গুরুত্ব অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এবং অফিস-আদালতের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে তা যখন বাংলাকে ছাড়িয়ে যায়, তখনই অনুতাপ হয়। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। দরকার শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার। গুণগত মানের দিকেও নজর দেওয়া দরকার। 

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরের বাংলা প্রচলনের জন্য সবার আগে চাই একটা যুগোপযোগী শিক্ষানীতি। একটা অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রাথমিক স্তরে অন্তত প্রচলিত হওয়া দরকার যার ভিত্তি হবে কেবল মাতৃভাষানির্ভর। চীন ও জাপানে এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তারা তো ইংরেজির যথেচ্ছ ব্যবহার না করেও জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে অধিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমাদের এখানে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য যথেষ্ট সদিচ্ছা থাকবারও প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের কথা বারবার বলছে এবং সে লক্ষ্যে কাজও করছে। একটি সর্বজনীন শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলা দরকার যার লক্ষ্য হবে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং তার গুণগত মান বৃদ্ধি। যেখানে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাধ্যম হবে এক ও অভিন্ন। 

একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতি হিসেবে অবশ্যই তা আমাদের আত্মমর্যাদার। কিন্তু রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলন করতে না পারাটা আমাদের ব্যর্থতা বটে। বিশেষত শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে আমাদের সত্যিকার অর্থে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার দুর্দশার মোচন করতে হবে।

  • শিক্ষক ও কলাম লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা