সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৪০ পিএম
একটি গোপন বন্দিশালার প্রতীকী নাম ‘আয়নাঘর’। গোপন বন্দিশালা বা ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত এই নামটি শুনতে যতটা সাদামাটা, ততটাই রহস্যঘেরা ও আতঙ্কময়। গত পনের বছরে বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মী নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেরে পর সাধারণের সামনে গোপন এই বন্দিশালায় বিনা বিচারে মানুষকে আটকে রাখার তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে আয়নাঘর নামটি। রাজধানীতে এ রকম তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এগুলোর অবস্থান রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরায়। ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছয় উপদেষ্টা, গুম কমিশনের প্রধান, গুমের শিকার আট ব্যক্তিসহ কয়েকজন সাংবাদিক আয়নাঘর পরিদর্শনকালে দেখেছেন, কীভাবে মানুষকে বন্দি করে নির্যাতন করা হতো। এসব বন্দিশালায় রয়েছে খুপরি ঘর, যেখানে আলো-বাতাস পৌঁছতে পারে না বললেই চলে। রয়েছে নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত চেয়ার।
ড. ইউনূস গোপন বন্দিশালাকে বীভৎসতা ও নৃশংসতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা তার একটি নমুনা।’ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকে বন্দিশালা থেকে মুক্তি পান। গুমের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার ২৭ আগস্ট গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়। ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ এখনও নিখোঁজ। আটটির বেশি গোপন বন্দিশালা শনাক্ত করেছে কমিশন।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বিগত সরকারের আরেক নির্মমতার চিত্র। প্রতিবেদন বলছে, সরকার প্রধানের নির্দেশেই বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৪০০ নিরস্ত্র মানুষকে। এর মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থী, নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী, নারী ও শিশু রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার মোট শিশু ১১৮। আহত প্রায় ১২ হাজার। বহু মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ‘টার্গেট কিলিং’ করা হয়েছে। ৬৬ শতাংশই মিলিটারি রাইফেলের গুলিতে এবং ১২ শতাংশ শটগানের গুলিতে নিহত হয়। ১১ হাজার ৭০০-এর বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হন। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এই নৃশংসতার পথ বেছে নিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়েও অভিযোগ তুলেছে। বলা হয়েছে, প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণে জড়িত ব্যক্তিরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন। আমরা মনে করি, দুটো ঘটনাই ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। দুটি ঘটনাই নৃশংস ও বর্বর। মানুষকে সামান্যতম মানবাধিকার থেকেও চরমভাবে বঞ্চিত করার উদাহরণ। এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের জনগণের বিরোধিতার মুখেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে এই ধরনের নির্মমতার পথ বেছে নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। পর পর তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করার পর নাগরিকদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ২০২৪ সালে। জনবিক্ষোভ ঠেকাতে তারা জনগণের বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। প্রতিবাদকারীদের ওপর নির্যাতন ও গুমের মতো ঘটনা ঘটায়।
আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি গণহত্যা ও আয়নাঘরের দৃশ্যমান চিত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহ সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের জন্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করবে। এতে যেসব তথ্যপ্রবাহ সামনে এসেছে তাতে অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথকে আরও সুগম করবে। তবে ১৫ বছর ধরে গুমের শিকার ব্যক্তি ও গণহত্যায় নিহত-আহতরা যাতে ক্ষতিপূরণসহ তাদের প্রতি বর্বরতার ন্যায়বিচার পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। জনরোষ ঠেকাতে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সব রাজনৈতিক দলকে সে লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। আমরা চাই, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথে দেশের উত্তরণ ঘটুক। বিগত স্বৈরশাসনের দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসুক আমাদের প্রিয় স্বদেশ।