জননিরাপত্তা
মোহাম্মদ আলী শিকদার
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৩৭ পিএম
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। জনআকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, এই সরকার একটি সুষ্ঠু-স্বচ্ছ-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি করার পাশাপাশি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও জনগণের অধিকারের সরকারি উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। তবে এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার জননিরাপত্তা ও আইন প্রয়োগের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশেষত, গত রাজনৈতিক সরকারের সময়ে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে যেভাবে তাদের রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল তা থেকে বাহিনীটিকে বের করে আনার উদ্যোগ লক্ষণীয়। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন ইতোমধ্যে বাহিনীটির জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবও প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করেছে। সরকার পুলিশ বাহিনীর সংস্কার এবং এই বাহিনীকে কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়েছে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দিকেও এগুচ্ছে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালনের ছয় মাস সময় পূর্ণ করেছে। কিন্তু সরকারের গৃহীত সংস্কার প্রস্তাব এবং উদ্যোগের মাঝেও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যেন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কারণ, জননিরাপত্তার শঙ্কা দেশের আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এ নেতিবাচকতা থেকে জননিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা যেমন বাড়ছে তেমনি জনদুর্ভোগও বাড়ছে। জননিরাপত্তায় সংকটের কারণ দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, খুন-ডাকাতি-ছিনতাইসহ বহুমাত্রিক দুষ্কর্ম।
চলতি ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিদিনের প্রতিবেদনগুলোয় চোখ বোলালেই অপরাধ যে বেড়েছে তা বোঝা সহজ হবে। বিশেষত সামাজিক পর্যায়ে কিছু অপরাধ বেড়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সংস্থা পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করার বিষয়েও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। আসলে পুলিশ বাহিনীর কাজ শুধু জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ, এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। পুলিশ বাহিনী আইন প্রয়োগ করে, জনগণকে আইনগত ও নিরাপত্তাজনিত সেবা দিয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে। এ এক কঠিন পেশা এবং একই সঙ্গে দায়িত্ব। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে পেশাদারিত্ব, জনগণের সেবা করার সদিচ্ছা রাখা এবং বৈষম্যহীনভাবে আইন প্রয়োগের মানসিকতাÑ এ তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়োগপ্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। অর্থাৎ অনেকে যেমন অভিযোগ করছে, পুলিশ বাহিনী পটপরিবর্তনের পর ধসে পড়েছে, তারা ভুল করছে। আসলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও রাষ্ট্রের কতিপয় অসাধুর স্বার্থোদ্ধারের জন্য সমাজে বৈষম্য গড়ে তোলার কাজে গত পনের বছরে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জননিরাপত্তা ঘুরেফিরে সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কারণ, জননিরাপত্তার সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের গতিবিধি, অর্থনীতি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নারীর ও শিশুর অধিকার রক্ষা, নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, রাষ্ট্র সুস্থিরভাবে আইনি কাঠামোয় পরিচালনা এমনকি জনপ্রশাসনের স্থিতিশীলতাও জড়িত। জননিরাপত্তাকে সার্বিকভাবে আলাদা করে দেখলে চলবে না। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা কী দেখছি? দেখছি নানা সংকট এবং জটিলতা, যা দিনদিন স্তূপীকৃত হচ্ছে এবং জনজীবনে জটিল সমস্যা তৈরি করেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সময়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদন মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রথমত ছাপা সংস্করণের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও স্বাভাবিক ছন্দে ফেরেনি। ধরা পড়েনি জেলপলাতক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা। আর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ আগস্টের পর জামিনে বেরিয়ে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ‘লাল দালানের বাসিন্দা’ এসব অপরাধীকে কীভাবে ‘ঘরে’ ফিরিয়ে আনা যায়Ñ সে পথ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। চলছে নতুন পরিকল্পনা। একই দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদনে জানানো হয়, অপারেশন ডেভিল হান্টে সারা দেশে নতুন করে ৬০৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও ১ হাজার ১৬৮ জনকে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে এ অপারেশনের বিষয়ে বলেছেন, ফ্যাসিবাদ বিদায় নিলেও তাদের দোসররা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে। তবে চলমান সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের পর দেশে আর কোনো ডেভিল থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে কোনো শয়তান যেন পালাতে না পারে এজন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। তিনি আরও বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানে জড়িত কোনো আসামি যাতে জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশ অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ নজর দিতে হবে।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে জননিরাপত্তা সংকটে পড়েছে। এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা গড়তে হবে। আমাদের মতো জনঘনত্বের রাষ্ট্রে প্রত্যেকের ডোর টু ডোর নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যদি সামাজিক ও এলাকা পর্যায়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এমনকি কিশোর গ্যাংয়ের মতো সংকট হটানো যায় তাহলে জনজীবনে স্বস্তি আসবে। রাষ্ট্রের নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে পরিবর্তিত হয়। আমরা দেখছি বিভিন্ন এলাকায় ছুরি-চাপাতি দিয়ে ছিনতাই হচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের ওপর ছুরিও চালানো হচ্ছে। অপরাধীরা যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং তাদের মধ্যে বাড়তি আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্তিশালী করার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিতিশীলতা এমনকি সীমান্তবর্তী সমস্যাগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু হলেও তাকে কাঙ্ক্ষিত বলা কঠিন, এমন অভিযোগ অধিকাংশ নিরাপত্তা বিশ্লেষকের। কারণ, শুধু পুলিশের পোশাক পাল্টালে কাঠামোর পরিবর্তন হবে না। পুলিশ বাহিনী শক্তিশালী করার জন্য তাদের আইন প্রয়োগ করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ অপরাধের অভিযোগ পেলে ঘটনাস্থলে যাবে, নিয়মিত টহল দেবে এবং সুনির্দিষ্ট অপরাধের তদন্ত করবে। তারা যেন তদন্ত এবং আইন প্রয়োগের স্বাধীনতা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এ সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একটি কাজই করতে হবে, আইন প্রয়োগে কোনো বৈষম্য কিংবা অন্যায্যতা রয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণে রাখা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা। পুলিশের নিয়োগের প্রক্রিয়ায়ও বদল আনা জরুরি। দেশে অনেক বেকার যুবক-যুবতী রয়েছে। তাদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও আছে। তাই পুলিশ বাহিনীতে সঠিক পদ্ধতিতে নিয়োগ এবং পুলিশ বাহিনীর কর্মীদের দক্ষ ও পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণব্যবস্থা গড়তে হবে। পুলিশ প্রশাসন গঠন এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি এবং এ প্রশাসনকে দ্রুত কার্যকর করতে হবে। কারণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নির্দেশনা জারি করা সহজ হয়। এমনকি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কাজটিও আর কঠিন থাকে না। ইতোমধ্যে যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আটকই বেশি হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এমন ভাবনা দূর করার জন্য জনসংযোগ বাড়াতে হবে। পুলিশের ওপর কমে আসা জনআস্থা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কাঠামোগতভাবে সক্ষমতার ক্রমাবনতি ঠেকিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো এবং জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্যই পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন জরুরি। আমাদের উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রযুক্তি ব্যবহারের পদ্ধতিগুলো জেনে নিতে হবে। ব্যাসিক বিষয়গুলো তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেখাতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ পুলিশ কর্মীই প্রযুক্তির টুকিটাকি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। এ বিষয়টি দূর করতেই নিয়মিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বিবেচনায় কনসালট্যান্সি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে হবে।
জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পুলিশের ভূমিকা মুখ্য, জননিরাপত্তায় নজর গভীর করার প্রয়োজন, অপরাধের উৎসে নজর দিতে হবে। অপরাধের উৎসে নজর দিতে হলে পুলিশকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের পুলিশ বাহিনীকে সমন্বয়মূলক ভূমিকায় নিয়ে আসতে হবে। তারা যেন জনগণের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে তা নিশ্চিত করা দরকার।