পবিত্র শবেবরাত
মুফতি এনায়েতুল্লাহ
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৩৫ পিএম
সীমাহীন বরকতময় রাতগুলোর মধ্যে শবেবরাত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আরবি ভাষায় একে বলা হয় লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যরাত। শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাত নিয়ে বহু হাদিস ও আলেমদের মতামত পাওয়া যায়, যা ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত নির্দেশ করে। এ রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং তাদের ক্ষমা করেন, অসীম দয়া ও করুণায় বান্দাদের ক্ষমা করেন, তাদের রিজিক নির্ধারণ এবং তাকদির লিপিবদ্ধ করেন। তবে আল্লাহর সঙ্গে শরিককারী ও পরস্পর শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের জন্য এ ক্ষমা প্রযোজ্য নয়।
এ বিষয়ে হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা শাবানের ১৫ তারিখ রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, তবে মুশরিক ও শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের ক্ষমা করেন না।’ Ñসহিহ ইবনে হিব্বান
আরেক হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) এ রাতে এত দীর্ঘ সেজদায় ছিলেন যে আমি ভীত হয়ে গেলাম এবং তার পা স্পর্শ করলাম। তিনি তখন পা নড়ালেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা শাবানের মধ্যরাতে পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের ভেড়ার পশমের সংখ্যার চেয়েও বেশি লোককে ক্ষমা করে দেন।’ Ñজামে তিরমিজি
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন শাবানের ১৫ তারিখ রাত আসে, তখন সে রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা সূর্যাস্তের পর থেকে আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কেউ কি আছে যে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। কেউ কি রিজিক চাইবে? আমি তাকে রিজিক দেব। কেউ কি আছে বিপদগ্রস্ত, যার বিপদ দূর করব? এভাবে আল্লাহতায়ালা ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।’ Ñসুনানে ইবনে মাজাহ
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, শাবানের ১৫ তারিখ রাতের ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদিস ও বর্ণনা রয়েছে, যা এ রাতের বিশেষ মর্যাদা প্রমাণ করে। বহু সাহাবি ও তাবেয়ি এ রাতে বিশেষ ইবাদত করতেন। তবে কিছু আলেম এ ফজিলত অস্বীকার করলেও অধিকাংশ ইসলামি পণ্ডিতের মতানুযায়ী, এটি একটি বিশেষ রাত; ইমাম আহমদের বক্তব্যও এর পক্ষেই ইঙ্গিত দেয়।’ Ñইকতিদা আস-সিরাত আল-মুস্তাকিম : ২/১৩৬
এ রাতের প্রধান আমল ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা। তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে শবেবরাত পালনের এক বিশেষ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অনেক পরিবার ঘরে হালুয়া-রুটি, ফিরনি, সেমাইসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার তৈরি করে। এ দিনে মৃত্যুবরণ করা আত্মীয়স্বজনদের কবর জিয়ারত, তাদের জন্য দোয়া এবং দানসদকার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে মসজিদগুলোয় বিশেষ ওয়াজ মাহফিল ও ইবাদতের আয়োজন হয়। এ ছাড়া অনেকে গরিব-দুঃখীদের মাঝে খাবার বিতরণ করেন, যা সামাজিক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শবেবরাতের অন্যতম বার্তা হলো, মানুষের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির চর্চা। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই এ রাতে আমাদের উচিত একে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীল হওয়া, পুরনো রাগ-ক্ষোভ ভুলে যাওয়া এবং সম্পর্ক পুনর্গঠন করা।
একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য পারস্পরিক সহমর্মিতা অপরিহার্য। শবেবরাত আমাদের আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেয় এবং প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালনের তাগিদ দেয়। এ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ রাতে আমাদের উচিত ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এ রাতে নফল নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়া করা উত্তম আমল এবং পরদিন রোজা রাখা সুন্নত। কারণ, নবী কারিম (সা.) শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন। এ ছাড়া তওবা ও ইসতিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং নিজেদের গুনাহের জন্য তওবা করা জরুরি। মুসলিম জাতি হিসেবে পরস্পরের শত্রুতা দূর করা, যেহেতু শত্রুতাপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমা করা হয় না, তাই কারও প্রতি বিদ্বেষ থাকলে তা দূর করা উচিত।
শবেবরাত আসলে একটি আত্মমূল্যায়নের রাত। এ রাতে আমরা আমাদের জীবনের ভুলগুলো বিশ্লেষণ করতে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালোমানুষ হওয়ার সংকল্প নিতে পারি। কেবল ইবাদত করলেই যথেষ্ট নয়, বরং আমাদের চিন্তা-চেতনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জরুরি।
শবেবরাত আমাদের জন্য এক মহাসুযোগ। এটি ক্ষমা, রহমত ও কল্যাণের রাত, যেখানে আমরা নিজেদের ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে এবং নতুনভাবে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারি। পাশাপাশি সমাজে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার চর্চা করাও এ রাতের অন্যতম শিক্ষা।
ইমাম ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন, শবেবরাতে মুমিনের কর্তব্য এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে জিকির, দোয়া ও ইসতিগফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামাজ পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায়, বলা যায় না। তাই কল্যাণের মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব লাভের আশা নিয়ে ১৫ তারিখের রোজা রাখা। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হলো, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দোয়া কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এগুলো সবই কবিরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
আগেই বলা হয়েছে, শাবানের মধ্যরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ রাত, যার ব্যাপারে হাদিসসমূহে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অতএব, আমাদের উচিত, এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো এবং আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহের ক্ষমাপ্রার্থনা করা। আন্তরিকভাবে তওবা করা, পাপমুক্ত জীবন গড়ার শপথ নেওয়া। মনে রাখতে হবে, পাপমুক্ত মানুষই হলো শান্তিময় সমাজ গঠনের মূল কারিগর। আল্লাহতায়ালা সবাইকে শবেবরাতের বরকত লাভে ধন্য করুন। দেশে শান্তির বাতাস জারি করে দিন। আমিন।