গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা
ড. আলা উদ্দিন
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪১ এএম
ড. আলা উদ্দিন
গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি অনন্য উদ্যোগ। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো দেশের দরিদ্র জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিশাল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে ১৪ হাজার ২০০ কমিউনিটি ক্লিনিক সারা দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। এই ক্লিনিকগুলো গ্রামীণ জনগণকে সহজে এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৫ কোটির বেশি মানুষ এ সেবার আওতায় এসেছে। এটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য একটি বিশাল অর্জন। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে ১৩ হাজার ৬৬৭ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) দ্বারা। সপ্তাহে ছয় দিন নিরলসভাবে তারা সেবা প্রদান করে থাকে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার ফলেই এ ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলছে। তবে চাকরির অনিশ্চয়তা, আর্থিক সুবিধা এবং কাঙ্ক্ষিত কর্মপরিবেশের অভাবের কারণে অনেকেই এ পেশায় স্থায়ীভাবে থাকতে পারছেন না অনেকেই। গবেষণায় জানা গেছে, সিএইচসিপিরা নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার, যা তাদের পেশাদারি এবং সেবাদানের মানসিকতা প্রভাবিত করছে।
প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে গড়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার রোগী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে। এ ক্লিনিকগুলো শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য নয়, বরং সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি পরামর্শ এবং বিভিন্ন সাধারণ রোগের চিকিৎসা এখানে প্রদান করা হয়। বিশেষত মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সেবা, যেমন প্রসব-পরবর্তী যত্ন, নবজাতকের টিকাদান এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য স্বাস্থ্যপরামর্শ; যেগুলো কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এর ফলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিকের অবদান অসামান্য।
এ ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে প্রায় ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, যা দরিদ্র জনগণের জন্য এক অনন্য সহায়তা হিসেবে কাজ করছে। এসব ওষুধের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের আর্থিক চাপ কমে যাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য হচ্ছে। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা শুধু ক্লিনিকে বসেই সেবা দেন না, বরং দুর্যোগের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ প্রদান করেন। মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাদের ত্যাগ এবং দায়িত্ববোধ অসাধারণ। করোনাভাইরাস মহামারির সময় তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখসারিতে কাজ করেছেন এবং জনগণের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। এটি শুধু চিকিৎসাকেন্দ্র নয়, বরং স্বাস্থ্যসেবার নতুন পথ উন্মোচনের একটি দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে দরিদ্র জনগণের জন্য এটি এক আশীর্বাদ, যেহেতু জনগণ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে। এর ফলে ব্যক্তিগত নয়, সমগ্র সমাজের স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিকের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান কর্মসূচি এবং পুষ্টি পরামর্শের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা শুধু চিকিৎসা প্রদানে সীমাবদ্ধ নন, তারা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতেও অবদান রাখছেন। তাদের প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং নারীদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনাসংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে তারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করছেন এবং নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাচ্ছেন।
কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের জন্য সাশ্রয়ী এবং কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। এই সেবা দীর্ঘমেয়াদে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে। তবে সেবা আরও কার্যকর করতে হলে ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
কমিউনিটি ক্লিনিকের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো গ্রামীণ জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা। শহরের উন্নত চিকিৎসাসুবিধা থেকে বঞ্চিত প্রান্তিক জনগণ এখন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারছে। আগে যেখানে দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাসেবা ছিল কঠিন, সেখানে এখন কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে তারা নিকটস্থ এবং নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পাচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে, যা দেশের জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত এ উদ্যোগ, বিশেষত মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে। প্রসবকালীন নিরাপদ ডেলিভারি ব্যবস্থার পাশাপাশি এখানে গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রসব-পূর্ব (এএনসি) এবং প্রসব-পরবর্তী (পিএনসি) স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষিত ধাত্রী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের তত্ত্বাবধানে সন্তান প্রসবের ফলে জটিলতা কমে যাচ্ছে এবং মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রভাব শুধু চিকিৎসাসেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি গ্রামীণ জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত করতে পারছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জটিল এবং প্রাণঘাতী রোগের প্রকোপ কমাতে সহায়ক হচ্ছে। বিশেষত করোনাভাইরাস মহামারির সময় কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামবাসীর জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছেন। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার। ২০১৮ সালে পাস হওয়া কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসহায়তা ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী, কর্মীদের সরকারি চাকরির সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর ফলে কর্মীরা অল্প বেতনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এবং অনেক সময় তাদের বেতনও সময়মতো পরিশোধ করা হয় না। তাই সংসার চালানো, সন্তানদের পড়াশোনা, দৈনন্দিন ব্যয় সবকিছু নিয়েই তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। এ সংকট কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং সামাজিক ও পেশাগত অবস্থানের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। করোনা মহামারির সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া কাজ করার সময় অনেক কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মারা গেছেন, অথচ তাদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। ন্যায্য পারিশ্রমিক ও সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেকেই পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন, যা দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুতর সংকেত।
কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের প্রধান দাবি হলো তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত করা, যাতে তারা ২০১৮ সালের কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসহায়তা ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী সরকারি চাকরির সুবিধা, যেমন বেতন বৃদ্ধি, চাকরির নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা লাভ করতে পারেন। তাদের বিশ্বাস রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা দূর হবে এবং তারা একটি সুসংগঠিত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশে কাজ করতে পারবেন। এ আইন অনুযায়ী তাদের জন্য উন্নত বেতনকাঠামো এবং অন্যান্য সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তবে বাস্তবতা দুঃখজনকভাবে ভিন্ন।
কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে, যা বিশেষত গ্রামীণ জনগণের জন্য একটি ব্যাপক সুবিধা হিসেবে কাজ করছে। এ ক্লিনিকগুলো দরিদ্র জনগণের কাছে বিনামূল্যে মানসম্মত সেবা পৌঁছে দিচ্ছে, যা আর্থসামাজিক অবস্থান উন্নত করতে সহায়ক। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক কর্মীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর এবং সঠিক বেতন ও সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং স্বাস্থ্যসেবা আরও কার্যকর, টেকসই ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সিএইচসিপিদের বঞ্চনা এবং অনিশ্চয়তা দূর করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এ পদক্ষেপগুলো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি সাধনে সহায়ক হবে, যা শেষে দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। কর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের জন্য ন্যায্য সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করে সরকার স্বাস্থ্যসেবা খাত আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করে তুলতে সক্ষম হবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সুরক্ষা লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।