শিক্ষা
ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৪ এএম
ড. মো. আশরাফুর রহমান ভূঞা
আটপৌরে জীবনে আনন্দ উপভোগ করা সহজ নয়। প্রশ্ন তোলা যায়, এ তো নতুন কথা নয়। চিরকাল মানুষ সুখের সন্ধানী। জীবনময় পরিপূর্ণ তৃপ্তিলাভ সম্ভব নয় নশ্বর পৃথিবীতে। ক্ষণিকের পুলকই জীবনের সঞ্জীবনী সুরা। সত্য হলো, জীবনযাপন তো হর্ষবোধকই।
পৃথিবী একটি গ্রহ মাত্র। সৌরজগতে আরও অনেক গ্রহ আছে। সব গ্রহে মানুষ নেই। পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কি না এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা নিরন্তর। মানুষ আছে বলেই পৃথিবী শ্রেষ্ঠতম গ্রহ। এ গ্রহবাসীর আনন্দ অতীব প্রয়োজনীয় এক মানবীয় উপসর্গ। বৃক্ষ নয়, পশু নয়, পাখি বা জন্তু নয়; নিরেট মানুষ আমরা পৃথিবীতে এই-ই তো পরম আনন্দের। প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থাপনায় কত অনুসর্গ। বৈচিত্র্যময় আকাশ; রহস্যঘেরা পাহাড়, মোহনীয় সমুদ্র এগুলো মানুষের চিত্ত ব্যাকুলিত করে। তাই রবীন্দ্রনাথ অকপটে বলেছেন, ‘মর্তভূমি স্বর্গ নহে। সে যে মাতৃভূমি-তাই তার চক্ষে বহে অশ্রুজলধারা, যদি দু দিনের পরে/কেহ তারে ছেড়ে যায় দু’দণ্ডের তরে। যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন/যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন/সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবার চায়-/ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায়/জননীর।’ এটি সর্বোতভাবে অনুভূতিজাত। নিষ্কাম মোক্ষলাভের নিমিত্ত কোনো কর্মে নিয়োজিত হওয়া এবং তাতে সফলকাম হলে সুখ বা আনন্দ অনুভূত হয়। তৃপ্তি আসে। মানুষ পুলকিত হয়।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, ‘সে সৃজনের মূলে কোনো অভাব দূর করার অভিপ্রায় নেইÑ সে সৃষ্টির মূলে অন্তরাত্মার স্ফূর্তি এবং তার ফল আনন্দ।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সুখ অতি সহজ সরল, কাননের/প্রস্ফুট ফুলের মতো, শিশু-আননের হাসির মতন...।’ হীরক রাজার দেশে ছবির একটি গানে আনন্দ এসেছেÑ ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে/শাখে শাখে পাখি ডাকে/কত শোভ্য চারিপাশে।’
বস্তুত আনন্দ সতত বিরাজমান। ব্যক্তিভেদে আনন্দ আহরণে ভিন্নতা আছে। শিশুর আনন্দ সবকিছুতে। যা দেখে, যা পায় নতুন অনুভূত হয় তার কাছে। নির্মল হাসিতে বরণ করে নতুনত্বকে। তার হাসি পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজনের পরিতৃপ্তির প্রেষণাদায়ক। কৈশোরের আনন্দ বাঁধনহারা জীবনে। শাসন, অনুশাসন, তাদের নিরানন্দ করে। সুদূরের আহ্বানে দুই হাত প্রসারিত করে তারা। দুরন্ত গতিতে ছুটতে চায় অজানাকে আলিঙ্গন করতে। তারুণ্য পুলকিত হয় গতিকে বরণ করার ক্ষেত্রে। এদের অভিযান অপ্রতিরোধ্য। পিছুটান তাদের অসহ্য। এরা উন্মত্ত, দিগ্বিদিক ছুটে চলায় স্বচ্ছন্দ। আবিষ্কারের নেশায় তারুণ্য উদ্বেলিত।
বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বর্ণিত বয়সের শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে বেশি। বলা যায়, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারকই এরা। এদের আনন্দ প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু আমলে নেয়? আমরা যদি শিক্ষাক্রম পর্যবেক্ষণ করি দেখব প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচি সরকার নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের মূল লক্ষ্য থাকে একটি শিক্ষিত জাতি গঠন করা। জ্ঞান অর্জন এবং অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার কৌশল বাতলে দেওয়া। অনুসন্ধিৎসু মনে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, জ্ঞান প্রদানের যে কৌশল টেক্সট বুক বোর্ড স্থির করেছে, শিক্ষার্থীর মনোজগতে এর প্রতিক্রিয়া পরিমাপক নেই। মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের একটা প্রক্রিয়া কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোয় চালু রেখেছেন যাতে বিদ্যা অর্জনের পরিমাপক হিসেবে জাতি ইংরেজি অক্ষরের কতগুলো প্রতীকে ( এ প্লাস, এ, এ মাইনাস ইত্যাদি) নিবদ্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীর শিক্ষা অর্জিত হলো কি না অভিভাবক এবং সেইসঙ্গে অবশ্যই শিক্ষকমণ্ডলী ফলাফল (সর্বোচ্চ এ প্লাস) সন্তোষজনক হওয়াকে অভিহিত করেন। এখানে আনন্দ নিরর্থক।
এ কথা অনস্বীকার্য, শিক্ষা প্রদান এবং গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আনন্দ বিষয়টি প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ এটি নির্ণয় করা এখনও সম্ভব হয়নি; যদিও প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সেই শিক্ষা শিক্ষা নয়।’ প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা এনসিটিবি নির্ধারিত তিনটি বই অধ্যয়ন করে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত); তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা); ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা, কৃষিশিক্ষা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, অর্থনীতি) পূর্ববর্তী সংখ্যার দ্বিগুণ হয়ে যায়। নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই গ্রুপভিত্তিক হয়ে থাকে। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া একজন শিক্ষার্থীর বইয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুধু পাঠ্যবই নয়, প্রশ্ন ও উত্তরপত্রের ধরনও পরিবর্তন হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বিধায় এ ক্লাসে প্রশ্নের ধরন কী হবে তা শিক্ষার্থীরা জানতে পারে। যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রশ্নকাঠামো কেমন হবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। আবার পঞ্চম থেকে (সমাপনী পরীক্ষা) ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন কাঠামোর প্রশ্নপদ্ধতিতে (সৃজনশীল, বহুনির্বাচনি) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়।
পরিলক্ষিত হয় প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই এবং প্রশ্নপত্র পদ্ধতির একটি পরিবর্তনের মধ্যে আবর্তিত থাকে। তাদের মনোজগতে এ পরিবর্তন প্রতিনিয়ত আঘাত করে। শিক্ষক, অভিভাবক সবাই শিক্ষার্থীকে নতুন পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত করতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্টসংখ্যক ক্লাসের পর (বাড়িতে অথবা স্কুলেই) অভিভাবকরা শিক্ষার্থীর মেধার স্তর পাহাড়সম উচ্চতায় উন্নীত করতে গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। এ নিয়োগ সময় (বিকাল, সন্ধ্যা, রাত)-সাপেক্ষ নয়; বিদ্যালয়ের স্তরসাপেক্ষ। বস্তুত দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কেবল ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’ তৈরির একটা প্রচেষ্টা আছে। ফলে এদের সহজাত স্ফুরণের পথ রুদ্ধ হচ্ছে, আনন্দ হচ্ছে উপেক্ষিত।
লক্ষণীয়, এ অবস্থা কেবল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই নয়; অভিভাবক, শিক্ষক এদের বেলায়ও প্রযোজ্য। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক এরাই সমাজ, এরাই রাষ্ট্র। যে পেশারই হোক তার সন্তান শিক্ষার্থী হলে তিনি অভিভাবক, যিনি পাঠদান করেন তিনি শিক্ষক। সমাজ এ ত্রয়ীর গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। আনন্দের পরিসীমা ব্যস্ত হওয়া উচিত এদের সবার মাঝে। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। এ আনন্দ আমাদের খুঁজতে হবে। এটি মানুষের মৌল অধিকার। প্রাণের উচ্ছলতার অভাব থাকলে সমাজ অচল হয়ে পড়বে। তাই সময় এসেছে ভাববার। সমাজের প্রাজ্ঞজনদের এগিয়ে আসার। মহল্লায় মহল্লায় অথবা গ্রামে গ্রামে শিক্ষার্থীদের ‘স্পেস’ দিতে হবে। এদের খেলার জায়গা এবং সময় দিতে হবে। বিদ্যা অর্জনের সঙ্গে যদি আনন্দের সংযোগ না থাকে, সে বিদ্যায় প্রকৃত শিক্ষা লাভ সম্ভব নয়।