সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:২৩ পিএম
আমরা বরাবরই অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বিরোধী। আমাদের কথাÑ উন্নয়ন হোক স্থানীয় বাস্তবতা বিবেচনায় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করে। কোনো মহলবিশেষের খুশি বা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নয়, বরং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হতে হবে মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতা প্রীতিকর নয়। গত পনেরো বছরে দেশে প্রচুর ভৌত অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। তার সুফল ও কুফল উভয় দিক নিয়েই রয়েছে আলোচনা। অনেক প্রকল্প যেমন অতিরিক্ত ব্যয়ভারে ন্যুব্জ, তেমনি অনেক প্রকল্পই ইতোমধ্যে অপ্রয়োজনীয় হিসেবেও চিহ্নিত। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কতটা অবকাঠামো প্রয়োজন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় তা ভাবা হয়নি। আবার জবাবদিহিতার অভাবে অনেক প্রকল্পের নির্ধারিত সময় পেরুলে বারে বারে সময় বাড়ানো হয়েছে, যাতে বেড়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের বোঝা। অনেক সময়ই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করে দেখা হয়েছে রাজনৈতিক ও মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থ।
তেমনি একটি প্রকল্প চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার হতে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। অথচ প্রকল্পের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৯১ শতাংশ। এরই মধ্যে চার দফায় মেয়াদ বেড়েছে। শেষ দফায় মেয়াদ বেড়ে কাজ হওয়ার কথা জুনে। কিন্তু তাতেও কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় আরেক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ হয়েছে। এর ফলে তিন বছরের প্রকল্প শেষ হবে আট বছরে। প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্পটি ব্যয় বেড়ে এখন ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় একদিকে যেমন প্রায় পাঁচ বছর সময় বেড়েছে, তেমনি ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৬৪
কোটি টাকা। সেই সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছে জনদুর্ভোগ।
যথাসময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে নকশার ভুলকে দায়ী করেছেন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সাবেক সচিব। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা ছাড়াই নকশা তৈরি করে প্রকল্প নেওয়ায় বাস্তবায়ন পর্যায়ে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে।’ স্বাভাবিকভাবেই নকশায় পরিবর্তন হলে ব্যয়ও বাড়বে, মেয়াদও বাড়বে। চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। কিন্তু এর মাঝে জনগণের অর্থের যে অপচয় হলো, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অতিরিক্ত হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেল, তার দায়ভার নেবে না কেউ।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং জনগণের প্রয়োজনে প্রকল্প নিতে হবে। ব্যক্তির স্বার্থ নয়, বরং বৃহত্তর জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই যে একের পর এক প্রকল্প, তার কতটা জেনে-বুঝে, জনস্বার্থের কথা ভেবে নেওয়া? এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকার কতটা সচেতন ছিল? এ কথা তো সত্য যে, না ভেবে কাজ করার ফল কখনই শুভ হয় না। এই চট্টগ্রামেই বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। যার অনেকগুলোই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে গলার
কাঁটা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের কার্যকারিতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তেমনি বন্দর নগরীর অনেক উড়াল সড়কও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। জলাবদ্ধতার নগরী চট্টগ্রাম অনেক অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পের ভারে ন্যুব্জ।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সড়কে গতি প্রয়োজন। সেই গতির পথ ধরেই উৎপাদিত পণ্য দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছবে, সাধারণের জীবনেও গতি ফিরবে। কিন্তু উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য যদি যেনতেন হয়, সেখান থেকে যদি অঢেল অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার বাসনা থাকে, তবে তা কোনোভাবেই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। যদি নীতি-আদর্শের মাথা খেয়ে, দেশ ও দশের কথা না ভেবে অবলীলায় নিজের পকেট ভারী করাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলেও উন্নয়নপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার, বিগত সরকারের আমলে দৃশ্যমান অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়নই অপরিকল্পিত হিসেবে চিহ্নিত। নগর পরিকল্পনাবিদরা অনেক প্রকল্পকেই অপ্রয়োজনীয়, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং জনস্বার্থের পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এসব প্রকল্প থেকে অর্থ লোপাট ছাড়া কার্যত সাধারণের উপকারের সম্ভাবনাও কম।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তিত সরকার যে সংস্কারপ্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে, তাতে আমরা গত সরকারের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে জনস্বার্থ বিবেচনায় অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে আগে সমাপ্তের জন্য বলি। সেই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় যেসব প্রকল্প এখনও শুরুই হয়নি, সেগুলো যেমন বন্ধ করতে বলি, তেমনি প্রকল্পের কাজ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হয় তা-ও নিশ্চিতের জন্য বলি। ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ বাক্যটি যেন কথার কথা হয়ে না থাকে, তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।