× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পরিবেশ

পুঁজিবাদ বনাম জলবায়ু পরিবর্তন

শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:২২ পিএম

শহিদুল ইসলাম

শহিদুল ইসলাম

রোজা লুক্সেমবার্গ ১৯১৭ সালের ২ মে তার বন্ধু সফি লিবনেক্টকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘গতকাল আমি জার্মানিতে গানের পাখি (সংবার্ড) নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ পড়ছিলাম। দেখলাম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তৈরি কৃষি খামার, হর্টিকালচার এবং কৃষিকাজ তাদের ঘরবাড়ি ও খাবারের উৎস কেড়ে নিয়েছে। আমি কষ্ট পাই। মানুষের এ চৌর্যবৃত্তি ও অসহ্য ধ্বংসযজ্ঞে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অসহায় ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতি এ নির্যাতন সহ্য করা যায় না। জুরিখে আমি প্রফেসর সাইবারের একটি বই পড়েছিলাম। তিনি উত্তর আমেরিকার রেডস্কিনের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা লিখেছেন, “সভ্য মানুষ ধীরে ধীরে পাখির শিকারের জায়গাগুলো দখল করে নেয়”।’

চিঠিটি লেখার কিছুদিন আগেই রাশিয়ার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। রোজা তখন জেলে বন্দি। সেখান থেকেই চিঠিখানা লেখেন। সে সময় তিনি হঠাৎ গানের পাখির কথা লিখতে গেলেন কেন? চিঠিতে সে কথাও লিখেছেন,‘নৈতিকভাবে দেউলিয়া অনেক রাজনীতিবিদের মতো আমিও প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়েছি শান্তির খোঁজে। কিন্তু শান্তি কোথায়? প্রকৃতির ওপর বিভিন্নভাবে যে নৃশংসতা লক্ষ করছি, তা আমাকে ভীষণভাবে পীড়িত করে।’ তিনি তার মধ্যে প্রকৃতির প্রতি পুঁজিবাদের চরম অবজ্ঞা লক্ষ করেন, সেই সঙ্গে খেটে খাওয়া শ্রমিকশ্রেণির প্রতি পুঁজিবাদের চরম ঘৃণা। এর ১০০ বছর পরের কথা। ২০১৬ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্যারিস চুক্তি গৃহীত হওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন শেষ প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন, ‘দ্য প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট অন ক্লাইম্যাট চেঞ্জ ইজ আ প্রেসিয়াস অ্যাচিভমেন্ট দ্যাট উই মাস্ট সাপোর্ট অ্যান্ড নারচার’। অর্থাৎ তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি আমাদের জন্য একটি অনন্য অর্জন। এ অর্জন আমাদের অনেকটুকু পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করতে পারে। 

তার এ বক্তব্য, বিশেষ করে তাদের উদ্দেশ্যেই উচ্চারিত হয়েছিল যারা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে ছিলেন ‘সংশয়বাদী’। শক্তিশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে এমন সব ব্যক্তি উঠে আসছেন যারা মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের স্লোগান ভুয়া কিংবা সামান্য পরিবর্তন হতে পারে; যা মানুষের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব। যেমন তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি অস্বীকার করে তার দেশকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। 

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই এর সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। ২০১৭ সালে প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি বলেছিলেন, এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একপ্রকার ‘শাস্তি’। এর কারণে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এরপর মেয়াদের শেষ দিকে ২০২০ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তিতে ফেরান। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সরকারগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই আবারও জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে গৃহীত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার নির্বাহী আদেশে সই করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মাধ্যমে গত এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী দেশটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রোগ্রামের প্রধান এরিক সোলহেইম বলেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ বিজ্ঞান অস্বীকার করেন। আপনারা যদি বিজ্ঞান অস্বীকার করেন, তাহলে আপনারা মধ্যযুগে ফিরে যাবেন।’ ২০১১ সালে ডারবান সম্মেলনেও যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল। তখন অন্য সবার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছিল। পৃথিবীর বড় বড় এনজিওগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটনের কাছে লিখিত চিঠিতে বলেছিল, যেকোনো আন্তর্জাতিক আলোচনার পথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রধান বাধা’।  এবারে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতাসীন হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এলেন। তিনি ওয়াশিংটন ডিসির স্পোর্টস ভেন্যু ক্যাপিটাল ওয়ান এরিনায় সমবেত সমর্থকদের সামনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে বলেছেন, ‘আমি অবিলম্বে অন্যায্য, একপেশে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি প্রতারণা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করছি। চীন যখন দায়মুক্তি পাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের নিজেদের শিল্পের ক্ষতি করতে পারে না।’ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তির বাইরে থাকা ইরান, লিবিয়া ও ইয়েমেনের পাশে নিজেদের নিয়ে গেলো। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদনে সবার চেয়ে এগিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম শিকার হবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো।

বিজয় প্রসাদ সম্পাদিত উইল দ্য ফ্লাওয়ার স্লিপ থ্রু দ্য এসফল্ট বইটির ভূমিকার কিছু অংশ পাঠকের সামনে উপস্থিত করি। বাংলায় অনুবাদ করলে এমনটি হতে পারে, ‘কঠিন শিলাপাথর ভেদ করে একটি ফুল বেরিয়ে আসবে।’ নামটা বড় অদ্ভুত! কিন্তু গভীর অর্থ বহন করে নামটি। ব্রাজিলের বিখ্যাত কবি কার্লোস ড্রুমন্ড ডি আন্ড্রেডের (১৯০২-১৯৮৭) বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘কানকাও আমিগা’র একটি বাক্য। ‘নিজের শ্রেণিতে বন্দি এ অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর পৃষ্ঠে ঘুরতে ঘুরতে একটি ফুলের সাক্ষাৎ পান, যে ফুলটি এখনও ফোটেনি। ফুলটির রঙ দেখা যায় না; কুঁড়িটার পাতাগুলো এখনও নিজেকে মেলে ধরেনি; কোনো বইতে ফুলটির নাম লেখা নেই; ফুলটি কুৎসিত, কিন্তু সত্যিই এটি একটি ফুল। এটি কুৎসিত। কিন্তু এটি একটি ফুল। এটি কঠিন শিলা, বিরক্তি, বিরাগ ও ঘৃণার মধ্য থেকে স্লিপ করে বের হয়ে এসেছে।’

১৯৪৫ সালে লেখা এ কবিতাটি দিয়েই বইটি শুরু করা হয়েছে। তবে সবার আগে নেটিভ আমেরিকার একটি প্রবাদবাক্যের উদ্ধৃতি বইটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেয়, ‘ট্রিট দি আর্থ ওয়েল,/ইট ওয়াজ নট গিভেন টু ইউ বাই ইউর প্যারেন্টস,/ইট ওয়াজ লোনড টু ইউ বাই ইউর চিলড্রেন্স।’ অর্থাৎ এ জগৎ আসলে আপনার বাবা-মা আপনাকে দেয়নি। বরং এটি আপনার কাছে একটি আমানত। আপনার পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের নিরিখে একটি আমানত। সাতজনের সাতটি মূল্যবান লেখা সম্পাদনা করেছেন বিজয় প্রসাদ। লেখকরা হলেন নাওমি ক্লেইন, কার্লোস ড্রুমন্ড ডে আন্ড্রেড, জন বেলামি ফস্টার, ঘাসান হাঘে, রাফিয়া জাকারিয়া, কুস্তুরাহ আলাতাস, শালিনি সিং ও সুসান আবুলহাওয়া। ১৭ পৃষ্ঠার এক মূল্যবান ভূমিকায় বিজয় পরজীবী পুঁজিবাদ ও তার প্রাকৃতিক এবং মানবিক আশ্রয়দাতার মধ্যে শক্তিশালী এক বৈপরিত্যের সন্ধান দেন এবং বলেন, ‘এ দুটি একই সঙ্গে টিকে থাকতে পারে না। একে অন্যকে ধ্বংস করবেই।’ তাই পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগে পুঁজিবাদ ধ্বংসের স্বপ্ন দেখাতে জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য লেখকদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

শেষ কথায় বিজয় প্রসাদ ইন্দোনেশিয়ার ‘মসলা দ্বীপের’ লবঙ্গ ও জায়ফলের সন্ধান পেয়ে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর অভিযান, আক্রমণ, হত্যা ও লুটপাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রমাণ করার চেষ্টা করে, বিশ্বায়ন নতুন কোনো প্রপঞ্চ নয়। শক্তিধর সংস্কৃতির আক্রমণে দুর্বল সংস্কৃতিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেই আদিপুরুষ ও আদি উৎপাদনব্যবস্থা এবং সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া আজ আর সম্ভব নয়। বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এর উৎসর্গপত্রটি। উৎসর্গ করা হয়েছে তাদের, যারা আমাদের অতিপ্রিয় পৃথিবী ও মানুষকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করেছেন। বিশেষ করে হন্ডুরাসের বারতা সেরেসেস (১৯৭২-২০২৬) ও মেক্সিকোর ইসিড্রো বালডেনগ্রো লোপেজ (১৯৬৬-২০১৭)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা পুঁজিবাদী রাক্ষসদের লোভলালসা থেকে তাদের জন্মস্থান মাটি, নদী, জঙ্গল ও সম্পদ রক্ষার্থে লড়াই করে নিহত হয়েছেন। তারা উভয়েই ছিলেন গোত্রপ্রধান। গাছ কাটা বন্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য লোপেজের বাবাকেও হত্যা করা হয়েছিল তার চোখের সামনে। তারা উভয়েই গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্ট প্রাইজ পেয়েছিলেন। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ওই ঘটনার রিপোর্টের সঙ্গে এ তথ্যও জানায় যে, ২০১৫ সালে লাতিন আমেরিকায় ১২২ জন জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী মানুষ নিহত হয় এবং সারা বিশ্বে ওই বছর ১৮৫ জনকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এভাবেই সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে পুঁজিবাদ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত করেছে। কোনো দেশই এর বাইরে নেই। আমরা আজও তাদের আদিবাসী বলে স্বীকার করি না। দেশে দেশে নানাভাবে তাদের বিলুপ্ত করতে চাই।

  • অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা