শেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:১৮ পিএম
শেলী সেনগুপ্তা
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। আমাদের রাষ্ট্রের উন্নয়নেও নারী দায়িত্ব পালন করেছে। কখনও কখনও তা অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু কেন যেন অধিকাংশ সময়েই তা গণনায় আনা হয় না। নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। একসময় শব্দটির ব্যবহার ছিল শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু এখন এর মূল লক্ষ্য জেন্ডার বৈষম্যহীন এক পৃথিবী গড়ে তোলা। যার মাধ্যমে নারীর জীবনে পরিবর্তন আসবে, নারী সমাজে ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে তার অধিকার নিশ্চিত হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তার মধ্যে প্রথমটি সমন্বিত উন্নয়ন, অর্থাৎ পরিবার ও সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো নারীর উন্নয়ন, দ্বিতীয়টি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অর্থাৎ সে বিষয়গুলো নারীর অধস্তনতা সৃষ্টি করে সে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের মধ্যে সচেতনতা জাগিয়ে তোলা এবং তৃতীয়টি হলো উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি অর্থাৎ নারী নিজের মূল্যায়ন করতে পারবে।
নারীর ক্ষমতায়নের মূল লক্ষ্য ক্ষমতার উৎস ও কাঠামো পরিবর্তন, নারীর সুপ্ত প্রতিভা এবং সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ, তার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সিদ্ধান্তসমূহে অংশ নিয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি। এর বাইরে আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই নির্যাতন চলে নানাভাবে, কখনও শিশুকালে পরিবারের পুরুষ শিশুটির সঙ্গে নারী শিশুর বিভেদের মাধ্যমে। কখনও পারিবারিক সমস্যা কিংবা অর্থনৈতিক কারণে নারী শিশুকেই আগে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে দেওয়া। এর মূল কারণ সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার না থাকা এবং একই মর্যাদায় না রাখা। সময় এসেছে এসব বৈষম্য দূর করার। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে সকল বাধা এখনই দূর করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নারী ও পুরুষের সমতা।
দেশের প্রচলিত ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে হতে পারে না। আবার একইসঙ্গে বলা হয়েছে, অভিভাবকের ইচ্ছে অনুযায়ী ১৬ বছর বয়সেও বিয়ে হতে পারে। আমরা জানি, একজন মেয়েশিশুর নারী হয়ে ওঠার পথে মূল বাধা এখানেই। ১৮ বছরের আগে কোনো নারী শিশুই নারী হয়ে ওঠে না। অধিকার কর্মী এবং চিকিৎসকরা তুমূল আপত্তি রয়েছে এ বিষয়ে। জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম হলে শিশু বলেই সংজ্ঞায়িত। তাহলে ১৮ বছরের আগে কারও বিয়ে হলে এটি অবশ্যই বাল্যবিয়ে হিসেবে বিবেচিত। এসব বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন করা অতীব জরুরি।
আজকাল মানুষের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। তাই বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব উত্তরাধিকারে সব ধর্মের নারী ও পুরষের জন্য অভিন্ন আইন প্রচলনের গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব করা হচ্ছে।
একটি দেশে সবার জন্য একই আইন থাকা দরকার। অথচ তা না থাকায় অনেক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতাও ঘটছে। পরিবারের মধ্যে আসছে বিচ্ছিন্নতা, নারী তার সম্মান হারাচ্ছে, গৃহহীন নারী পথে নামছে, স্থান মিলছে না পিতৃগৃহেও।
একইভাবে নারী শ্রমিকরা সমান শ্রম দিয়েও মজুরিবৈষম্যের শিকার। অথচ শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। তারপরও বলতে পারি, কর্মক্ষেত্রে নারীর পথচলা কোনো কালে কখনই মসৃণ ছিল না। এর পেছনের কারণ কর্মক্ষেত্রে সঠিক এবং নারীবান্ধব পরিবেশ না থাকা। অনেক সময় নারীরা কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন দ্বারাও নিগৃহীত হন।
আমাদের অর্থনীতিতে নারীর অবদান বিশাল। বিশেষত তৈরি পোশাকশিল্পে। বাংলাদেশের তৈরিপোশাক বিশ্বময় সমাদৃত। আমাদের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করা পোশাকশিল্পের শতকরা আশিভাগ শ্রমিকই নারী। এই নারীদের জন্য বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের পোশাক সমাদৃত। নারী প্রশাসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিচার বিভাগেও নারীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণেও পুলিশ বিভাগের নারী সদস্যরা অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। সেনাবাহিনীতেও নারী তারা যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে। তারপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর কর্মসংস্থানের অন্তরায় হিসেবে নারীর যোগ্যতা সম্পর্কে নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষের আস্থার অভাব, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব, বৈষম্যমুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব, নিরাপদে চলাচলের নিশ্চয়তার অভাব, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সামাজিক বিরোধিতা, নারীর যোগ্যতা ও ভূমিকা সম্পর্কে প্রথাগত মনোভাব, গার্হস্থ্যকর্মে নারীর একক অংশগ্রহণ ইত্যাদি কারণকে বিবেচনায় রাখা হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি লিঙ্গবৈষম্যের অন্যতম পুঁজি নারীর মাতৃত্ব। অভিযোগ রয়েছে প্রতিনিয়ত নারীকে মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়া কিংবা অবস্থানে বাধা দেওয়া হয়। তারপরও যারা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন তাদের অনেকেই সমান মজুরি পাওয়া থেকে বঞ্ছিত হন। এখন সময় এসেছে বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারের সমাধান করার।
শুধু শ্রম, মজুরি কিংবা বাল্যবিয়ে রোধ নয়, নারীকে কেন্দ্র করে আরও অনেক কিছুই ভাবার সময় এসেছে। সময় এসেছে সুষ্ঠু সমাধান করে এই সমাজকে উন্নত সমাজে পরিণত করার। নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। কারণ সুস্থ মানুষ সমাজের সম্পদ। একজন সুস্থ মা একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারে। বিষয়গুলো মনে রেখে চিকিৎসাব্যবস্থা এগিয়ে নিতে হবে। নারীকে উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ডানা ভেবে তার প্রতি সম্মানসূচক আচরণ করতে হবে। একজন মানুষের সম্মান তখনই নিশ্চিত হয় যখন মানুষটি অর্থনৈতিকভাবে সফল। এজন্যই সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীর ভূমিকা ও অধিকার সব সময়ই গতিশীল। নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিও আশু প্রয়োজন।
নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনের সহযোগিতাও প্রয়োজন এবং সে বিষয়ে নারীকে সচেতন হতে হবে। সমাজ পরিবর্তন চায়। যেসব পরিবর্তন সমাজের মঙ্গল ডেকে আনে তা অবশ্যই গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তাই এখন থেকে শুরু হোক নারীর সম-অধিকারের বিষয়টি নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা ও তার কার্যকর প্রয়োগ।