× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি

ড. আব্দুল্লাহ হেল কাফী

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:১৬ এএম

ড. আব্দুল্লাহ হেল কাফী

ড. আব্দুল্লাহ হেল কাফী

কোনো সরকারের সক্ষমতা, সমালোচনা করার প্রেক্ষাপট, তাদের ভুলত্রুতি চিহ্নিত করাসহ গণতান্ত্রিক চর্চার নানা ক্ষেত্রে ছয় মাসই আদর্শ সময় বলে বিবেচিত। পটপরিবর্তনের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় তখন সমগ্র দেশবাসী একত্রিতভাবে সংস্কারের প্রত্যাশা করেছে যা দেশের ইতিহাসে দুর্লভ। এমন একটি অবিস্মরণীয় প্রেক্ষাপট নির্মাণের কাজটি জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দারুণভাবে সম্পন্ন করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাস পর আমাদের ওই পরিবর্তনের মূল্যায়নের নিরিখে তাদের কার্যক্রম বিচার করতে হবে। এ কথা প্রথমে মেনে নিতে হবে, আধুনিক রাষ্ট্রে কোনো সরকারই সম্পূর্ণ জনগণের মনঃপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। তাই সরকারের ওপর প্রায়ই নানা অভিযোগ ও মানুষের ক্ষোভমূলক উক্তি বা বাক্য থাকে। কিন্তু আমরা যখন অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করব তখন অবশ্যই জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট আমলে নিয়ে বিচার করব। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা এবং ব্যর্থতা কিংবা ভুলত্রুটি চিহ্নিত করব। একই সঙ্গে এ ব্যর্থতার পেছনের কারণও চিহ্নিত করে প্রত্যাশা রাখব সরকার সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। এজন্যই সংবাদমাধ্যমে এসব নির্দিষ্ট মেয়াদে মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।

দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার বেশকিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমত, সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় দেশের প্রতিভাবান ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছে বিভিন্ন দায়িত্বে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক এ বণ্টনের ইতিবাচক দিকটি অনেকে এড়িয়ে যান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছে। আবার একই সঙ্গে জনপ্রশাসনে পদোন্নতিসহ নানা নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সরকারের দূরদর্শিতা ও প্রাকপ্রস্তুতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। অন্তত রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংস্থাগুলোকে তারা প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাত ও এর ব্যবস্থাপনায়ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেরেছে। আর্থিক খাতের দৈন্যদশার ফলে দেশের অনেক ব্যাংক তারল্যসংকটে ভুগতে শুরু করে। তখন আর্থিক খাতের দুর্দশা জনজীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার একাধিক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও নীতি প্রণয়ন করেছে; যা আর্থিক খাত বিশেষত ব্যাংকগুলোকে আবার শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার সমতল মঞ্চ গড়ে দিয়েছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ থাকলেও তা দৃশ্যমান পর্যায়ে আনার মতো প্রেক্ষাপট গড়তে পারেনি। যদি বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকার বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নিত, তাহলে জনগণ উপকৃত হতো এবং পরবর্তী শাসকদের জন্য তা একটি উদাহরণ হয়ে থাকত। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের মধ্যে জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও প্রশংসনীয় কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও আমাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, সুরক্ষা ও বণ্টনের ক্ষেত্রেও ভালো সমন্বয় করতে পেরেছে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার একটি রাষ্ট্র পরিচালনার মতো পেশাদার উদাহরণ বিগত ছয় মাসে তৈরি করেছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা দৃশ্যমান সাফল্য দেখাতে পারেনি বলে জনমনে এ সরকারের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। আর এর সুযোগ নিতে চাচ্ছে রাজনৈতিক একটি তৃতীয় পক্ষ, এমন একটি অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অস্থিতিশীল পরিবেশ বিদ্যমান থাকায় রাজনৈতিক, মতাদর্শিক নেতিবাচকতা ছড়ানো সহজ। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার দৃশ্যমান সফলতা দেখাতে পারেনি। বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে এবং এর ফলেই জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে; যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এমনটি প্রত্যাশিত ছিল না। বরং সরকারকে জনগণসহ রাজনৈতিক দলের অবাধ সহযোগিতা ও সমন্বয়ের সদিচ্ছা ঠিকই ছিল। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সহজেই কাঠামো ও নাগরিকের সমন্বয় করতে পারত। কিন্তু তা যে হয়নি এখন ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পুলিশকে পূর্ণ সক্ষমতায় পায়নি। বরং পুলিশ বাহিনীর অনেকেই তখন পলাতক এবং শুধু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজটিতেও জনবলের অভাব ছিল। ওই সময় পুলিশ বাহিনীতে বাস্তবায়নযোগ্য স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের কার্যক্রম শুরু করা গেলে ভালো হতো। একই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও সরকারের উদ্যোগগুলো দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেনি। এমন এক সংকটপূর্ণ সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্থার উন্নতি ও সক্ষমতা বাড়ানোর কাজটি মনোযোগ দিয়ে করতে হতো। এমনটি করলে জননিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করা যেত। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই নানা অবস্থান থেকে দাবি-দাওয়া এবং জালিয়াতি বেড়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। সম্প্রতি ‘আদিবাসী’ শব্দ পাঠ্যবইয়ের ছবি থেকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গটিই মূলত এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এমন অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এত এত দাবি জনদুর্ভোগ বাড়াচ্ছে এবং একই সঙ্গে জনগণের একতা দুর্বল করে তুলছে। এসব সমস্যা সমাধান করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার মাঠ পর্যায়ে অনেক কিছুই করতে পারত। জনপ্রশাসন কার্যকর করে তোলা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থার কাঠামো সুসজ্জিত করে ক্ষমতা বণ্টন, রাষ্ট্রের কাঠামোয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি চিহ্নিত করা এবং স্বল্পমেয়াদি পর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য প্রাথমিক সংস্কার-সমাধান, আন্তর্জাতিক মহলে অর্থনৈতিক কূটনীতি পরিচালনা, দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ এগুলোই মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। জনগণ মূলত এসব বিষয়েরই পরিবর্তন চেয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার মধ্যে একটি ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বিশেষত বিগত ১৫ বছরে দেশে রাজনৈতিক দমন ও বৈষম্য একটি বড় সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেধার বদলে পেশিই রাজনৈতিক মর্যাদা পেয়েছে। দেশের মানুষকে সব সময় সেবা দেওয়া জনপ্রশাসনকেও রাজনীতিবিমুক্ত করা এবং রাজনীতিতে মেধা ও সৃজনশীলতা ফিরিয়ে আনার মতো নিরপেক্ষ রাজনৈতিকতা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে শুরুতে ছিল। ধীরে ধীরে কোনো কারণে সরকারের সঙ্গে জনগণের সরাসরি যোগাযোগে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আরও সরল কারণ অন্তর্বর্তী সরকার এমন প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিয়েছে যে, তাদের শাসন পরিচালনার জন্য জনগণের সম্মুখীন হওয়া জরুরি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যোগাযোগটি ধারাবাহিকতা হারিয়ে বর্তমানে অনেকাংশে বিপরীতার্থক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ফলে এরই সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ। তারাই মূলত রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত রেখেছে এবং পরিবেশ অস্থিতিশীল করে রেখেছে। এজন্যই আমরা দেখছি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নানা দাবি উত্থাপিত হচ্ছে নানা মহল থেকে। আবার সরকারেরই কোনো নীতি ব্যবহার করে নিজ রাজনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে নিজ ব্যানারে নিতে চাচ্ছে। এমনটি হতো না যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিষয়ের কাজটি সরকার করতে পারত। এ কাজ করার এখনও সময় আছে। যত দেরি হবে, ততই সরকারের জন্য নানা নেতিবাচকতা তৈরি হবে। ‘ডিম আগে নাকি মুরগি আগে’র মতো সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগেÑ সে তর্কে জড়িয়ে এখন অনেকেই অস্থির হয়ে উঠছেন। বিশেষত আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও ভারতের সঙ্গে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ভারতই রহস্যময় আচরণ করছে আমাদের সঙ্গে। অন্যদিকে দেশের মানুষও বাইনারি বিভাজনে পড়ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ছয় মাসে তাই সার্বিকভাবে ব্যর্থতার ভার বেশ কয়েকটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে প্রকট। বিশেষত রাজনৈতিক মব তৈরি হয়েছে এবং এসব মব মূলত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষতি করছে। এর ফলে সরকারের জন্য সংস্কার কার্যক্রমও কঠিন হয়ে উঠছে। বিশেষত পাহাড় বনাম সমতল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য সম্পাদন, মাজার এবং বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় বা প্রতিষ্ঠান ভাঙার ঘটনাগুলোর অনেক দিক রয়েছে যা জনগণের মনে সরকার সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। ফলে অসন্তোষ বাড়ছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন স্বচ্ছ-সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক-নজির স্থাপনকারী নির্বাচন আয়োজনে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। সম্প্রতি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ দেশের নানা স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং হামলার ঘটনাতেও এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বলেই ধরা পড়েছে। এ ঘটনার পর দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানায়। অর্থাৎ বিএনপিও বুঝতে পারছে, গণতান্ত্রিক কাঠামো অনেকাংশেই অনুপস্থিত যা দেশে অস্থিতিশীলতাই জিইয়ে রাখবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে দূরদর্শী হয়ে ভাবতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সংস্কারের কাঠামো। না হলে অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া দিতেই থাকবে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদেরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এখন সময় অর্থনৈতিক অগ্রগতি, প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য দূরীকরণ, সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার।

  • রাজনীতি-কূটনীতি বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা